সৌদি সরকার বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী ৪২ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে চাপ দিচ্ছে। গত কয়েক বছরে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় তোলার পর সম্প্রতি বাংলাদেশকে একাধিক চিঠি দিয়ে বিষয়টি সমাধান করতে বলেছে সৌদি আরব। বিষয়টি সম্প্রতি আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সম্মেলনের আলোচনাতেও এসেছে। ঢাকায় ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে অনুষ্ঠেয় দুই দেশের যৌথ কমিশনের বৈঠকে সৌদি আরব প্রসঙ্গটি তুলতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রগুলো।
ঢাকা ও রিয়াদের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, সৌদি আরব মনে করে, বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে এসব রোহিঙ্গা আকাশপথে সে দেশে গেছে। তাই এদের বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নিতে হবে। এ নিয়ে গত বছর একাধিকবার বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে সৌদি আরব। ওই চিঠির জবাবে বাংলাদেশ বিষয়টি আরও বিস্তারিতভাবে জানাতে সৌদি আরবকে অনুরোধ করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, ফেব্রুয়ারির ১২ ও ১৩ তারিখ ঢাকায় দুই দেশের যৌথ কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি আসতে পারে।
যৌথ কমিশনের বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ গতকাল রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এবারের আলোচনায় বাংলাদেশ কর্মী পাঠানো, ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়ানো, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর মতো বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার দেবে। আর সৌদি আরবের অগ্রাধিকার থাকবে অনিয়মিত হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি।
অনিয়মিত হয়ে পড়া বাংলাদেশি নাকি বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টিতে সৌদি আরব জোর দিচ্ছে জানতে চাইলে গোলাম মসিহ বলেন, ‘সৌদি আরব এখনো বিস্তারিতভাবে আমাদের জানায়নি। তবে দেশটি বারবার অবৈধ লোকজনকে ফেরানোর তাগিদ দিচ্ছে।’
সামনে বড় চ্যালেঞ্জ
সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগদান, ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের একতরফা অভিযানে জোরালো সমর্থন ও প্রতিরক্ষা চুক্তি সই দুই দেশের সম্পর্কের উষ্ণতার বার্তা দেয়। এমন এক আবহে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের ফেরানোর বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা।
জানুয়ারি মাসের ১৩ তারিখ আবুধাবিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে সম্মেলনের আয়োজন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রদূত সম্মেলনে উপস্থিত একাধিক কূটনীতিক এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরানো যে দুই দেশের সম্পর্কের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, সেটি গোলাম মসিহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে তুলে ধরেছেন। রাষ্ট্রদূতের মতে, বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী ৪২ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে সম্প্রতি ঢাকায় চিঠি পাঠিয়েছে রিয়াদ। আগামী কয়েক বছরে এদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গটি সামনে রাখবে সৌদি আরব। কাজেই তাদের ফেরানোর বিষয়ে কি হবে, তা নিয়ে সরকারের নীতিগত অবস্থান ঠিক করা উচিত বলে মত দেন রাষ্ট্রদূত।
>বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গা ইস্যুটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রদূত সম্মেলনে।
অধিকাংশই মক্কার আশপাশের
২০১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশকে ৪২ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয় সৌদি আরব। বিস্তারিতভাবে সবার নাম-পরিচয় না থাকলেও কোন সময় থেকে এরা সৌদি আরবে রয়েছে, কীভাবে গেছে আর কী ধরনের পাসপোর্ট ব্যবহার করেছে, তা সৌদি আরব চিঠিতে জানিয়েছে। বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, সৌদি আরব যে ৪২ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে আনতে বলছে, তাদের বেশির ভাগের উপস্থিতি মক্কার আশপাশে। দেশটি এরই মধ্যে যে তিন লাখ রোহিঙ্গার ইকামা (বৈধ কাজের অনুমতিপত্র) দিয়েছে, তাদের বেশির ভাগই থাকেন মক্কা নগরী ও তার আশপাশে। যে ৪২ হাজার রোহিঙ্গাকে সৌদি আরব ফেরত পাঠাতে চায়, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইকামাধারী রোহিঙ্গাদের পরিবারের সদস্য। এদের একটি বড় অংশ ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের পর সৌদি আরব গেছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরব যেসব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশকে তাগিদ দিচ্ছে, তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে গেছেন। আবার কেউ কেউ সৌদি আরবের বাংলাদেশ মিশন থেকে পাসপোর্ট নিয়েছেন কিংবা নবায়ন করেছেন।
সমস্যাটা নতুন নয়
সৌদি আরব অতীতেও, বিশেষ করে ২০০৭-০৮ এবং ২০০৯-১০ সালে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের ফেরানোর বিষয়ে আলোচনায় তুলেছে। তবে ওই সময়ে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি দেশটি। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর রিয়াদ সফরের সময় সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের বিষয়টি আলোচনায় তুলেছিলেন। তখন বাংলাদেশ বলেছিল, মিয়ানমারের নির্বাচনে অং সান সু চির ক্ষমতায় যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদল হলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারের নাগরিক, সেটা সৌদি আরবও জানে। বাংলাদেশের ব্যবস্থার ফাঁক গলে রোহিঙ্গারা সৌদি আরব গেছে বলে তাদেরকে আমাদের নিতে হবে, এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে জোর চেষ্টা চালাতে হবে।’