রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় দুটি মামলার গ্রেপ্তার ৪২ আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে তাঁদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে গত রোববার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জে রামনাথপুর ইউনিয়নে মাঝিপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া ও ভাঙচুর চালানো হয়। পাশাপাশি গবাদিপশু, স্বর্ণালংকার ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী লুট করা হয়। এ ঘটনায় গত সোমবার ৪২ জনকে আটক করা হয়েছিল। তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হলো।
পীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরেস চন্দ্র বলেন, হামলার ঘটনায় দুটি মামলারই বাদী হয়েছেন পীরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইসমাইল হোসেন। এর মধ্যে একটি মামলা হয়েছে হিন্দুদের বাড়িঘরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটের অভিযোগে। এই মামলায় ৪১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় অনেককে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এই মামলার একমাত্র আসামি করা হয়েছে এক কিশোরকে, যার বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই কিশোরকে গত সোমবার জয়পুরহাট থেকে ধরা হয়।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তার কিশোরকে রংপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে হাজির করা হলে সে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জেলা পুলিশের আদালতে দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শক গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ অভিযুক্তের বয়স ১৯ বছর বলে আদালতে তুলে ধরে। শুনানি শেষে আদালত আসামিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
পীরগঞ্জে সোমবার রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে হামলায় যাঁদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। কেউ আশ্রয় নিয়েছিলেন স্থানীয় মন্দিরে, কেউ প্রতিবেশীর বাড়িতে। তিনটি পরিবার ছিল রেড ক্রিসেন্টের করা অস্থায়ী তিনটি তাঁবুতে।
রুপিন চন্দ্র দাস (৬০) নামের ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যক্তি বলেন, ‘সব তো শেষ। এখন বৃষ্টিটায় হইছে যন্ত্রণার। থাকি কোনটে।’
সুমন চন্দ্র স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে রাতে মন্দিরে ছিলেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘ঘুমাইনি, সারা রাত চুপচাপ বসে ছিলাম।’
এদিকে পীরগঞ্জে হামলা ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতি পরিদর্শন করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ও রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনের সাংসদ শিরীন শারমিন চৌধুরী। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ করে দেওয়া হবে। যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে, সেই অর্থসহায়তা দেওয়া হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আর্থিক যে সহায়তা প্রয়োজন, সেটিও দেওয়া হবে।
স্পিকার বলেন, এ ধরনের ন্যক্কারজনক নাশকতামূলক ঘটনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, সুষ্ঠু তদন্তের মধ্য দিয়ে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। পীরগঞ্জে এ ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় রংপুর জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গতকাল সন্ধ্যায় পীরগঞ্জের হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর পরিদর্শন করেন। তিনি পরে ক্ষতিগ্রস্ত ২৫টি পরিবারকে ৫ হাজার করে টাকা ও ২০ কেজি করে চাল সহায়তা দেন। মন্ত্রী বলেন, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও পীরগঞ্জে হামলার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে, তারাই এসব ঘটনা ঘটিয়েছে।
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে দলটির একটি কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল গতকাল পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায় হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও ঘরবাড়ি পরিদর্শন করে। এ সময় হাসানুল হক বলেন, আওয়ামী লীগ এ হামলার দায় এড়াতে পারে না।
এদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘরে হামলার ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল রংপুর জেলা শহরে বিভিন্ন সংগঠন কর্মসূচি পালন করে। দুপুর ১২টায় জেলা যুবলীগ শহরের বেতপট্টি এলাকার দলীয় কার্যালয় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। পরে প্রেসক্লাব চত্বরে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জেলা যুবলীগের সভাপতি সিরাজুম মুনির। বক্তব্য দেন রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনের সাংসদ আহসানুল হক চৌধুরী, রংপুর মহানগর অওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুরাদ হোসেন প্রমুখ।
রংপুরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের যৌথ উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়।