৪০ হাজার লবণচাষি বিপাকে

কক্সবাজার উপকূলে মাঠে পড়ে আছে লবণের স্তূপ। কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদণ্ডী এলাকায়। গতকাল সকালে। প্রথম আলো
কক্সবাজার উপকূলে মাঠে পড়ে আছে লবণের স্তূপ। কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদণ্ডী এলাকায়। গতকাল সকালে।  প্রথম আলো

লবণ উৎপাদনের ভরা মৌসুমেও ন্যায্যমূল্য না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন কক্সবাজার উপকূলের অন্তত ৪০ হাজার প্রান্তিক চাষি। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লবণ উৎপাদন, বিপণনের সঙ্গে যুক্ত অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ। লবণচাষিদের অভিযোগ, আমদানির কারণেই কমে গেছে লবণের দাম।

কক্সবাজার লবণচাষি সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আনোয়ার পাশা চৌধুরী বলেন, সংকটের অজুহাত তুলে অসাধু একটি চক্র বিদেশ থেকে লবণ এনে দেশীয় লবণশিল্পকে ধ্বংস করছে। এর ফলে সম্ভাবনাময় লবণশিল্পটি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ৪৪ হাজার প্রান্তিক চাষিসহ লবণ ব্যবসায় জড়িত জেলার অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ। 

চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে প্রতি মণ লবণ ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও ফেব্রুয়ারি মাসে দরপতন শুরু হয়। তখন প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকায়। আর গত সপ্তাহে মণপ্রতি লবণের দাম কমেছে আরও ৩০ টাকা। এখন প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়। লোকসান দিয়েও লবণ বিক্রি না হওয়ায় হতাশ চাষিরা মাঠ ছাড়তে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে পাঁচ হাজার চাষি লবণ উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, চলতি মৌসুমে ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত জেলার আটটি উপজেলায় ৬০ হাজার ৫৫৯ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিকটন। আর লবণের বার্ষিক জাতীয় চাহিদা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৪৮ হাজার মেট্রিকটন। তবে গত ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতি মৌসুমের তিন মাসে লবণ উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিকটন। যা গত মৌসুমের এই সময়ের তুলনায় কম। গত মৌসুমের এ সময়ে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ৪ লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিকটন।

১ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিকটন লবণ উৎপাদন কম হওয়ার কারণ হিসেবে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় চাষিদের হতাশাকে দায়ী করছেন বিসিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের নেতারা। বর্তমানে মাঠে লবণ উৎপাদনে জড়িত ৪৪ হাজারের বেশি চাষি পরিবার।

পড়ে আছে দুই লাখ টন লবণ 
টেকনাফের সাবরাং উপকূলে এখন লবণ উৎপাদনের ধুম পড়েছে। কিন্তু বেচাবিক্রি তেমন নেই। চাষিরা উৎপাদিত লবণ মাঠে গর্ত খুঁড়ে মজুত করছেন। কেউ কেউ গুদামে ফেলে রাখছেন। গতকাল মঙ্গলবার সাবরাং ইউনিয়নের মগপাড়া, আছারবনিয়া, নয়াপাড়া এলাকা ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। 

আছারবনিয়া এলাকার চাষি আবুল কাশেম (৫৫) বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসেও প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছে ১৮০-২০০ টাকায়। এখন ১৫০ টাকা। অথচ প্রতি মণ লবণ উৎপাদন খরচ যাচ্ছে ২৫০ টাকা। লোকসান দিতে দিতে হয়রান চাষিরা। 

টেকনাফ লবণ ব্যবসায়ী ও চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি শফিক মিয়া বলেন, এখন টেকনাফে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। মাঠ থেকে লবণ ট্রাকে তুলতে পরিবহন খরচ যায় ৩০ টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি মণ লবণের দাম পড়ছে ১২০ টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজির দাম পড়ছে ৩ টাকা। অথচ খুচরা বাজারে প্রতি কেজি লবণের দাম ২৫ থেকে ৪০ টাকা। এসব তদারকির যেন কেউ নেই। 

বাংলাদেশ লবণচাষি বাঁচাও পরিষদের আহ্বায়ক সাজেদুল করিম বলেন, ‘লবণের দরপতন ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। এ জন্য আমরা সাত দফা দাবি বাস্তবায়নে স্মারকলিপি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছিলাম। কিন্তু এখনো তার প্রভাব পড়েনি।’

দাবিগুলোর মধ্যে আছে মাঠপর্যায়ে লবণের মূল্য প্রতি কেজি ১১ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ, লবণ আমদানি নিষিদ্ধ, সহজ শর্তে লবণচাষিদের ঋণ প্রদান, বিসিকের মাধ্যমে ২ লাখ মেট্রিকটন লবণ ক্রয় ও মজুত ইত্যাদি। 

জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, লবণের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। দ্রুত তার বাস্তবায়ন হবে। 

কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, সরাসরি মাঠ থেকে ১ লাখ মেট্রিকটন অপরিশোধিত লবণ কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। লবণ কেনা শুরু হলে দাম বাড়বে।