একটা, দুইটা, তিনটা...হাজেরা বেগমকে প্রায়ই এভাবে গুনতে হয়। না গুনে করবেন কী? ৪০ সন্তানের দেখভাল কি সোজা কথা?
হাজেরা বেগমের চোখভরা মমতা, বুকভরা ভালোবাসা, আঁচলজুড়ে অপত্য স্নেহ। একজনকে চুমু দিচ্ছেন, পাশ থেকে একসঙ্গে কয়েকজন এসে জড়িয়ে ধরে চুমু দিতে থাকে। একজনের কথা শুনতে থাকলে চারপাশ থেকে আরও কয়েকজনের কথা শুনতে হয়। একসঙ্গে কি সবার কথা শোনা যায়? তাই একটু–আধটু ধমকেও দেন। তবে মন থেকে নয়, এমনি এমনি।
রাজধানীর আদাবরে একটি ভাড়া বাসায় হাজেরা ও তাঁর ৪০ সন্তানের সংসার। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের সহায়তায় চলা ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হাজেরা বেগম। সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটির মাধ্যমে সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। সংগঠনটি সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে নিবন্ধন করা। হাজেরা বেগমের উদ্যোগে গড়ে ওঠা সংগঠনটির বয়স ১০ বছরের কাছাকাছি। এখন হাজেরার চোখে একটিই স্বপ্ন—এই শিশুদের জন্য জমি কিনে একটি বাড়ি বানানো। তবে স্বপ্ন ডালপালাও মেলছে। তাই হাজেরা বলে যান, এই শিশুদের জন্য একটি স্কুল হবে, কলেজ হবে। এই শিশুদের মায়েরা বয়স্ক হয়ে গেলে যখন আর যৌনপেশায় থাকতে পারবেন না, তাঁদের জন্য একটি বৃদ্ধাশ্রমও থাকবে।
রোববার দুপুরে খাওয়ার সময় দেখা গেল, হাজেরা বড় এক থালায় ভাত আর পাঙাশ মাছ নিয়ে বসেছেন। তাঁর চারপাশে কম করে হলেও সাত থেকে আটজন বসা। একজন করে হাঁ করে, হাজেরা বেগম বড় বড় করে ভাত–মাছের লোকমা মুখে তুলে দেন। কেউ কেউ দূরে থাকলেও তারাও মাঝে মাঝে এসে হাঁ করে খাবার মুখে নিয়ে অন্য দিকে চলে যায়। খাওয়ানো শেষ করতে করতে হাজেরা বেশ খানিকটা হাঁপিয়ে গেলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘বয়স হইছে, এখন আর এইগুলার সাথে পারি না।’
মুখে এ কথা বললেও হাজেরা বেগমের মুখে একধরেনর তুপ্তির হাসি। এই হাসি শুধু মায়েরাই হাসতে পারেন। হাজেরা যে এই ৪০ জনের মা!
৪০ জনের মধ্যে ৫ জন শিশুর মা বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করেন। আর অন্যদের মায়ের পেশা যৌনকর্ম। তাঁদের জীবন কাটে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায়। সন্তানকে একটু নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার জন্যই মায়েরা নিজের সন্তানকে হাজেরা বেগমের কাছে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন।
অনেকে আছেন, সন্তানকে দিয়ে যাওয়ার পর আর কখনো খবর নিতে আসেননি। কয়েকজন শিশুর মা রাস্তায় অপঘাতে মারা গেছেন। তিন সন্তান রেখে এক যৌনকর্মী মা কাজের জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন, সেখানেই তিনি মারা গেছেন, এই তিন শিশুকে দেখার জন্য তাদের নানি ছাড়া পৃথিবীতে আছেন এই হাজেরা বেগম।
একজনকে কাছে টেনে নিয়ে হাজেরা বললেন, ‘এ হইছে আমার তিন ঘণ্টার বাচ্চা। বুঝলেন না, মা জন্ম দেওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যেই আমারে দিয়া চইল্যা গেছে, এই বাচ্চা মায়ের বুকের দুধও খাইতে পারে নাই।’ একজন এসেছিল নয় মাস বয়সে। তার মা নেশা করতেন, পথেই মরে ছিলেন, এই বাচ্চা মরা মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল, তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশ হয়েছিল। এমনই নানা বয়সের শিশু আছে এখানে। আড়াই বছর থেকে শুরু করে বেশ বড় শিশুও আছে। বড় শিশুরা ছোটদের সামলে রাখে। সামলে রাখতে রাখতে মারামারি লাগে। আবার ঠিকও হয়ে যায়। তাই দুপুরে খাওয়ার পর দেখা গেল, একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে।
শুরুতে হাজেরার এত ছেলেমেয়ে ছিল না। আস্তে আস্তে সংখ্যা বাড়ায় বর্তমানে যে বাসা, তাতে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। কয়েকটি ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে বা কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত করার আগ পর্যন্ত ওদের পাশে থাকতেই হবে। তাই ১ জানুয়ারি থেকে নতুন বড় একটি বাসায় যাবে হাজেরার পরিবার। ঘরগুলোর চারপাশে এরই প্রস্তুতি। একটি সংগঠন নতুন বাড়ি ভাড়ার অর্ধেক টাকা দেবে বলে চুক্তি হয়েছে।
কাজের ফাঁকে হাজেরা জানালেন এত সন্তানের মা হয়ে ওঠার গল্প। ঘরে সৎমার অত্যাচারে আট বা নয় বছর বয়সেই ঘর ছাড়েন তিনি। এরপর থেকে হাজেরা পথে বড় হয়েছেন। তিনি ভালো করেই জানেন, একটি শিশুর জন্য পথে বড় হওয়া কতটা কষ্টের ও যন্ত্রণার। পকেটমার হওয়া, সরকারের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় পাওয়া, পালানো এবং একপর্যায়ে শিশু বয়সেই হাজেরা জড়িয়ে যান যৌন পেশায়। তাই তিনি চান না, একটি শিশুও যেন শিশু অবস্থায় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়। হাজেরা বেগমের জন্ম ১৯৭১ সালে।
২০০০ সালের দিকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ-এর এইচআইভি-এইডস নিরোধ কার্যক্রমের আওতায় গঠিত হয় ঢাকার পথে থাকা যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘ। হাজেরা প্রথম কাজ শুরু করেন যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিয়ে গঠিত দুর্জয় শিশু নিবাসে। ২০০৮ সালে নিবাসটির জন্য বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলেও হাজেরা বেগমের নিজস্ব জমানো টাকাসহ বিভিন্ন সহায়তার মাধ্যমে প্রায় আড়াই বছর এই শিশুদের দেখভাল করতে থাকেন। কিছু ঝামেলা হলে পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যাঁরা দুর্জয়ের শিশুদের সহায়তা করতেন, তাঁদের সহায়তাসহ বিভিন্ন জনের সহায়তা নিয়ে হাজেরা ২০১০ সালে সাভারে ২৫টি বাচ্চা নিয়ে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠনটি শুরু করেন। রাজধানীতে স্থানান্তরের পর এখন সন্তানের সংখ্যা ৪০।
হাজেরা জানালেন, বড় হওয়ার পর কোনো কোনো মা সন্তানকে নিয়ে যান, তবে এখন পর্যন্ত এখানে বড় হওয়া কোনো মেয়ে যৌন পেশা বেছে নিয়েছে, সে খবর পাওয়া যায়নি। পোশাকশিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন কাজ করছে তারা। ছেলেরাও বিভিন্ন কাজ করছে।
হাজেরা যখন ছেলেমেয়েদের গুণগান গাচ্ছিলেন, তখন তাঁর চোখমুখ খুশিতে চিকচিক করছে। ঢাকার বাইরে একটি ভালো স্কুলে দুজন পড়ে, তারা এসএসসি দেবে। মোট তিনজন এসএসসি দেবে। তিনজন অষ্টম শ্রেণিতে, দুজন পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী দিয়েছে। দুজন অষ্টম শ্রেণিতে উঠবে। একজন নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হবে।
হাজেরা বললেন, ‘আমার ছেলেমেয়েদের কয়েকজন গানও শেখে।’ ছেলেমেয়েরা যখন গান গেয়ে শোনায়, তখন হাজেরা বারবার বলতে থাকেন, ওইটা তো তোমরা আরও ভালো গাইতে পারো, গাও।
ছেলেমেয়েদের তিন বেলা খাবার, পড়াশোনা, বাড়িভাড়াসহ বিভিন্ন খাতে মাসে খরচ প্রায় দেড় লাখ টাকা। কেউ হয়তো মাসে এক বস্তা চাল পাঠিয়ে দেন। শীতের সময় কেউ দেন কম্বল। পড়াশোনার জন্য কেউ কেউ এগিয়ে আসেন। দেশের বাইরে থাকা কয়েকজন বছরে কিছু নিয়মিত টাকা দিয়ে সহায়তা করেন। কিছু পারিবারিক ট্রাস্ট, ব্যক্তি উদ্যোগের সহায়তাতেই চলছে সংগঠনটি। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেমেয়েরা শুরুতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা এখন বড় চাকরি করেন। তাঁদের সেই সহায়তার হাত অব্যাহত আছে, কেউ কেউ সংগঠনের কমিটিরও সদস্য। আর মেডিকেলপড়ুয়া কিছু ছেলেমেয়ে স্বাস্থ্য ক্যাম্প বা বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এই শিশুদের চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছেন। আগের চেয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসায় এখন অনেক স্কুল নিজেরাই এই ছেলেমেয়েদের ভর্তি করতে চাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা যে স্কুলে পড়ছে, সেই স্কুল কর্তৃপক্ষও এই ছেলেমেয়েদের পরিচয় জানে।
হাজেরা বেগম বলেন, ‘সারা মাস চলব, এই নিশ্চয়তা সব সময় থাকে না। তারপরও চলছে তো। বাচ্চারা তিন বেলা খাবার পাইতেছে। পড়তাছে। দেশের যে মানুষ আছে তারাই যদি হাত বাড়ায়, এই কয়টা ছেলেমেয়ের জীবনটাই পাল্টাই যাইতে পারে।’
হাজেরা বেগমের ছেলেমেয়েদের অনেকেই তাদের মায়ের পেশা সম্পর্কে জানে। মা দেখতে এলে কেউ যাতে মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে, তা বলা আছে। হাজেরা বলেন, ‘আমি ওদের বলছি, তোমাদের মা তোমাদের ভালো চান বলেই তো এইখানে রাইখ্যা গেছে। তা না হইলে পথে থাকলে তো চোর-বাটপার হইতা। এখন খাইতে ও পড়তেও পারতেছ।’
আপনার নিজের কোনো ছেলেমেয়ে নেই—এ প্রশ্নে হাজেরা বেগমের উত্তর, ‘আমার এতগুলান সন্তান, নিজের আবার আলাদা কইরা থাকনের দরকারটা কী?’