নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিশোধ করছে না সরকারি সংস্থাগুলো। ৩৭টি মন্ত্রণালয়ের কাছে ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮৬১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাওনা ৩০১ কোটি টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে কর আদায়ের হার মাত্র ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এলাকা ও জমির শ্রেণিভেদে ভূমি উন্নয়ন কর বছরে সর্বনিম্ন ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত ভূমির উন্নয়ন কর ৪০ থেকে ৩০০ টাকা। শিল্পকাজে ব্যবহৃত জমির ক্ষেত্রে তা ৩০ থেকে ১৫০ টাকা। আর আবাসিক ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত জমির ক্ষেত্রে এলাকাভেদে জমির খাজনা বছরে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা।
ভূমি মন্ত্রণালয় বলছে, দীর্ঘদিন ধরে সরকারি সংস্থাগুলো নিয়মিত কর পরিশোধ করছে না। বিভিন্ন সময় চিঠি দিয়েও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাদের জানিয়েছে, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের জন্য বরাদ্দ না থাকায় তা পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মাক্ছুদুর রহমান পাটওয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা সবার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। কিন্তু সরকারি সংস্থা, মন্ত্রণালয়গুলোর কর বকেয়া থাকে। স্থানীয়ভাবে সহকারী কমিশনারসহ (ভূমি) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি সংস্থাগুলোকে কর পরিশোধের জন্য একাধিকবার চিঠি দিয়েছেন। ভূমি সংস্কার বোর্ড থেকেও মন্ত্রণালয়গুলোকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত এপ্রিল পর্যন্ত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ভূমি উন্নয়ন কর বাকি ৩০১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এই মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কর আদায়ের হার মাত্র ১ শতাংশ। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাওনা ২০৮ কোটি টাকা, এর মধ্যে বন বিভাগের কাছে পাওনা ১৯৫ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খাজনা বাকি পড়েছে ৭৮ কোটি ৭২ লাখ টাকার বেশি। একই মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের বকেয়া ২ কোটি ৮ লাখ টাকা। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ৬১ কোটি ৪৩ লাখ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৪১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, গৃহায়ণ ও গণপূর্তের ৩১ কোটি ৫৮ লাখ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের ১৫ কোটি ৬৮ লাখ, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ৩১ কোটি ৬৮ লাখ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২৫ কোটি ২০ লাখ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ১১ কোটি ৯ লাখ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৬ কোটি ৭১ লাখ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৪ কোটি ১২ লাখ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ২ কোটি ৯১ লাখ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১ কোটি ৮ লাখ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৩ কোটি ৫৩ লাখ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১১ কোটি ৭২ লাখ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২ কোটি ১৩ লাখ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ২ কোটি ২২ লাখ টাকা খাজনা বকেয়া পড়েছে।
এ ছাড়া ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, কৃষি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, অর্থ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিটির বকেয়ার পরিমাণ ১ কোটি টাকার ওপরে।
অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর বাকি ৯৮ লাখ টাকা, আইন মন্ত্রণালয়ের ১৭ লাখ ৯৪ হাজার, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ১৬ লাখ, তথ্য মন্ত্রণালয়ের ৮৫ লাখ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৯৩ লাখ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ৩৭ লাখ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (এনজিওবিষয়ক ব্যুরো, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ ও জাতীয় গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কাছে মিলিয়ে) ১ লাখ ৯৫ হাজার, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ২ লাখ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ৫৬ লাখ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৩ লাখ ৬ হাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১০ লাখ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ৪১ লাখ এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের খাজনা বাকি পড়েছে ৬৬ হাজার টাকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দীন খান প্রথম আলোকে বলেন, ভূমি উন্নয়ন কর হলো আদি ও অকৃত্রিম কর। একসময় এটাই ছিল রাজস্ব আয়ের মূল উৎস। কিন্তু ক্রমে সেটি নিচের দিকে চলে গেছে। সাধারণ মানুষ এই কর পরিশোধ করলেও সরকারি সংস্থাগুলো কর পরিশোধ করে না। এই কর আদায়ে তেমন কোনো তৎপরতাও নেই। শুধু ভূমি উন্নয়ন করই নয়, টেলিফোন বিল, বিদ্যুৎ বিলসহ সেবা খাতের বিলগুলোও সরকারি সংস্থাগুলো নিয়মিত পরিশোধ করছে না। অব্যবস্থাপনার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সরকারের উচিত এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া।