সংসারের অভাব দূর করতে গিয়েছিলেন মালয়েশিয়া। সেখানে ছয় বছর থাকার পর দেশে ফিরে আসেন। ঢেউটিন বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু লোকসান হওয়ায় ওই ব্যবসা বন্ধ করে দেন। এরপর বাড়িতেই গড়ে তুলেন মুরগির খামার। শ্রম ও নিষ্ঠার কারণে এই মুরগির খামার দিয়েই তাঁর জীবনে সুদিন ফিরে এসেছে। ২ লাখ দিয়ে ব্যবসা শুরু করে তিনি এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক।
এই পরিশ্রমী ও সফল ব্যবসায়ীর নাম ইয়াহিয়া বিশ্বাস। বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নে। তাঁর খামারের নাম হাচিনা পোলট্রি ফার্ম। তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার তাঁর।
শুরুর কথা
২০০৩ সালে পৈতৃক সাড়ে ৫ শতাংশ জায়গায় শুরু করেন মুরগির খামার। মুরগি পালনের জন্য তিনটি গোলপাতার ঘর নির্মাণ করেন। ঘর তিনটি নির্মাণে খরচ হয় ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি ঘরে খরচ হয়েছিল ৩৫ হাজার টাকা করে। মূলধন বলতে তার হাতে ছিল মাত্র ৯৫ হাজার টাকা। শুরু করেছিলেন কক মুরগি দিয়ে।
শুরু করেছিলেন কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনটি ঘরে তিনি ৩ হাজার মুরগির বাচ্চা পালন শুরু করেন। প্রতিটি মুরগির বাচ্চা কিনেছিলেন ১৫ টাকা দরে। কক মুরগিগুলো সাধারণত ৫৫-৬০ দিনে বিক্রয়যোগ্য হয়। বিক্রি করার আগ পর্যন্ত প্রতিটি মুরগির জন্য খাবার বাবদ ৯০-১০০ টাকা ও অন্যান্য খরচ বাবদ ১০ টাকা খরচ হয়। সব মিলিয়ে ১২০-১৩০ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি মুরগির ওজন সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮ গ্রাম। প্রতি কেজি কক মুরগি বিক্রি হয় ১৯০ থেকে ২১০ টাকায় । মুরগিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা লাভ হতো।
দুই বছরের মধ্যে ইয়াহিয়া আরও দুটি ঘর বৃদ্ধি করেন। এভাবে চলতে থাকে ২০১৬ পর্যন্ত। এই সময় তিনি গোপালগঞ্জ বাজারে শুরু করেন মুরগির ব্যবসা। খামার ও ব্যবসা দুটোই চলতে থাকে। খামার পরিচালনা ও ব্যবসায় ইয়াহিয়াকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা এবং অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তাঁর স্ত্রী সাবিনা বেগম (৩৮)।
ইয়াহিয়া আরও বলেন, লাভজনক হওয়ায় তিনি ২০১৬ সালের শেষ দিকে লেয়ার মুরগি পালন শুরু করেন। এর মধ্যে গড়ে তোলেন দোতলাবিশিষ্ট লেয়ার মুরগির পালন শেড।
>উদ্যোক্তার নাম ইয়াহিয়া বিশ্বাস
বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে
বাড়িতে গড়েন মুরগির খামার
খামার দিয়েই জীবনে সুদিন
জেলায় এমন উদ্যোক্তা খুব কম
সরেজমিনে ইয়াহিয়ার খামারে
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের মধুমতি নদীঘেঁষা মানিকদাহ এন হক কলেজের একটু পশ্চিম পাশে যেতেই চোখে পড়ে হাচিনা পোলট্রি ফার্মের সাইনবোর্ড। মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ডান পাশে ইয়াহিয়ার সেই পুরোনো তিনটি ঘর, যেগুলোতে তিনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ঘর তিনটির অবকাঠামো ঠিক থাকলেও নেই সেই আগের গোলপাতার চালা। গোলপাতার জায়গায় সিমেন্টের টিনের চালা। তার একটু সামনে এগোতেই দেখা যায় ইয়াহিয়া কর্মচারীকে নিয়ে কাজে ব্যস্ত। দক্ষিণ পাশে তার দোতলাবিশিষ্ট ৪ হাজার ৪৪৫ বর্গফুটের লেয়ার মুরগির শেড। ইয়াহিয়া বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির এই শেডটি নির্মাণ করতে তাঁর ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
মুরগি পালন পদ্ধতি
মুরগি কীভাবে পালেন—এমন প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, ‘২০১৭ সালে লেয়ার মুরগি পালন শুরু করি। প্রতিটি লেয়ার মুরগির জন্য দেড় বর্গফুট জায়গা লাগে। প্রতিটি লেয়ারের বাচ্চার দাম ২০-৩০ টাকা। এই বাচ্চগুলো ডিম দেওয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলতে ৫-৬ মাস সময় লাগে। ডিম পাড়ার উপযোগী হতে প্রতিটি মুরগি প্রায় ১০ কেজি খাবার খায়। যার বাজারমূল্য ৪৫০ টাকা। ওষুধ ও অন্যান্য খরচ হয় গড়ে ১০০ টাকা।’
ইয়াহিয়া বিশ্বাসের খামারে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন ওই এলাকার ছয়জন নারী ও পুরুষ। তাঁদের মধ্যে আসমা বেগম (৩০) বলেন, ‘আমরা এখানে কাজ করে সংসার চালাই। এখানে কাজ করার আগে সংসারে অভাব ছিল। স্বামীর একার টাকায় সংসার চলত না। এখন আমি কাজ করে যে টাকা পাই, তা দিয়ে সংসার ভালোভাবে চলছে।’
ইয়াহিয়া তাঁর খামারের আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে গিয়ে বলেন, তাঁর খামারে ৫ হাজার লেয়ার মুরগি আছে। প্রতিদিন গড়ে ৪২৫০টি ডিম দেয়। প্রতিটি ডিম ৬ থেকে ৭ টাকা বিক্রি হয়। প্রতিটি মুরগি ১২ থেকে ১৬ মাস ডিম দেয়।
খামার করে ভাগ্য বদলে যাওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি ২ লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। এখন আল্লাহর রহমতে জমি কিনেছি, বাড়িতে দোতলা ভবন করেছি, পাশেই বড় পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছি। মাছ চাষ করতে আমার বাড়তি কোনো খরচ হচ্ছে না। এখান থেকে বছরে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা বাড়তি আয় হচ্ছে।’
গোপালগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আজিজ আল মামুন বলেন, ‘জেলায় এমন উদ্যোক্তা খুবই কম। ইয়াহিয়ার মতো আরও উদ্যোক্তা তৈরি হলে এই জেলা থেকে বেকার সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে।’