বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয় ১৯৯৩ সালে। বিলুপ্তির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ওই বছর গঠন করা হয়েছিল বিলুপ্ত সেল। কিন্তু ২৮ বছরেও বিলুপ্তির কাজ শেষ হয়নি।
সম্পত্তি ভাড়া দেওয়া ছাড়া তেমন কোনো কাজ না থাকলেও বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ আছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ করা হয়েছে ১ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরেও একই পরিমাণ বরাদ্দ ছিল।
বাংলাদেশ জুট করপোরেশন (বিজেসি) বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। সংস্থা বিলুপ্তির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ওই বছর গঠন করা হয়েছিল বিলুপ্ত সেল। কিন্তু ২৮ বছরেও বিলুপ্তি সেলের কাজ শেষ হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে সম্পত্তি ভাড়া দেওয়া ও ভাড়া আদায় করা ছাড়া দৃশ্যমান কোনো কাজ হয়নি। সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতেও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে বিজেসি। সংস্থার সম্পত্তির প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগই চলে গেছে বেদখলে।
চাষিদের জন্য পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত, পাটের মূল্য স্থিতিশীল রাখা ও বিদেশে পাটের বাজার প্রসারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জুট মার্কেটিং করপোরেশন, স্পেশাল প্রোপার্টি জুট সেল, জুট ট্রেডিং করপোরেশন, এ পি সি র্যালি বাংলাদেশ লিমিটেড ও বাংলাদেশ জুট এক্সপোর্ট করপোরেশনকে একীভূত করে ১৯৮৫ সালের ১ জুলাই বিজেসি গঠন করা হয়।
তবে বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা হ্রাস, অব্যাহত লোকসান ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে ৮ বছরের মধ্যে ১৯৯৩ সালে ২৪ নম্বর বিজেসি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সংস্থাটির সম্পত্তি বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্থা গুটানোর কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে ২৪৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ে ১৯৯৩ সালের ১১ অক্টোবর বিলুপ্ত সেল গঠন করা হয়। অবসর, মৃত্যু, চাকরি ছেড়ে দেওয়াসহ নানা কারণে বর্তমানে ওই সেলের মাত্র সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। তবে সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আরও ৫৪ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিজেসির এক কর্মচারী বলেন, ‘জমি ভাড়া দিই, ভাড়া সংগ্রহ করি আর সম্পত্তিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করি। এর বাইরে আমাদের কোনো কাজ নেই।’ ভবিষ্যতে কী হবে এ সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা নেই সংশ্লিষ্টদের। এ বিষয়ে বিজেসির পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়েবসাইটে যাবেন, সব পাবেন।’ ওয়েবসাইটে তথ্য নেই জানালে তিনি বলেন, ‘তথ্য দেওয়া হবে।’
বিজেসি কি এভাবেই চলতে থাকবে—এমন এক প্রশ্নের জবাবে বস্ত্র ও পাটসচিব মো. আব্দুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো তাৎক্ষণিকভাবে বলা যাবে না। কারণ, সরকার তো এখনো একজন অতিরিক্ত সচিবকে চেয়ারম্যান হিসেবে দিয়ে রেখেছে। আমি চাইলে তো কালকে বন্ধ করে দিতে পারব না। আমি একমত যে এটা বিলুপ্ত করার পথে আসতেই হবে। ১ বছরে না পারি, ২ বছর, ১০ বছর বা ২০ বছরে পারব। কিন্তু এটা কি চলতেই থাকবে? এটা তো হওয়া উচিত না।’ তিনি বলেন, বিজেসির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা লাগবে। চিন্তা করতে হবে, কী করা যায়।
বিজেসি সূত্র জানায়, সংস্থাটি গঠনের সময় এর প্রায় ৬৮৬ একর জমি ছিল। বিলুপ্ত ঘোষণার পর থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৩৯১ একর জমি বিক্রি করা হয়েছে। ২০১২ সালের সম্পত্তি বিক্রি বন্ধ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ২৯৫ একর সম্পত্তি আছে। তার মধ্যে ১৯০ একর জমি বেদখলে। এসব সম্পত্তি উদ্ধারে বর্তমানে ২৮২টি মামলা চলছে। দখলে থাকা সম্পত্তির মধ্যে প্রায় ৬৭ একর জমি ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
জমি বেদখলসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে বিজেসির চেয়ারম্যান শশাঙ্ক শেখর ভৌমিকের কার্যালয়ে গত ১১ নভেম্বর গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে ২ ডিসেম্বর সকাল থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তাঁর কার্যালয়ে অবস্থান করলেও তিনি আসেননি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ধরেননি।
বিজেসির পরিচালক আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনবল কম আমাদের। যারা দখল করেছে, তারা প্রভাবশালী। তারা মামলাবাজ। বুঝে মামলা করে। এসব কারণে আমরা বেদখল জমি উদ্ধার করতে পারছি না।’
সম্পত্তি ভাড়া দিয়ে আয় করে বিজেসি। আর বেতন-ভাতাসহ মোট ৪৮টি খাতে খরচ করে থাকে সংস্থাটি। বিজেসির ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় ছিল ৫ কোটি ৬১ লাখ, ব্যয় ছিল ৩ কোটি ৭২ লাখ। মুনাফা ছিল ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। পরের অর্থবছরে মুনাফা কমে দাঁড়ায় প্রায় ৬৮ লাখ টাকায়। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেটে প্রতিষ্ঠানটির আয় ধরা হয়েছিল ৫ কোটি ৫০ লাখ, ব্যয় ৪ কোটি ৩৫ লাখ এবং মুনাফা ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
জানা যায়, বিজেসিকে দুজন কর্মচারীর (২-৪ গ্রেডের) পেছনেই বছরে ব্যয় করতে হয় সাড়ে ৩৬ লাখ টাকা। তার মধ্যে বেতন ১৯ লাখ এবং ভাতা সাড়ে ১৭ লাখ টাকা। এই দুজনসহ ২০২০-২১ অর্থবছরে কর্মচারীদের পেছনে ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।
সম্পত্তি ভাড়া দেওয়া ছাড়া তাদের তেমন কোনো কাজ না থাকলেও বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ আছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ করা হয়েছে ১ লাখ টাকা ও ২০২০-২১ অর্থবছরেও একই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
এ ছাড়া প্রশিক্ষণ, প্রচার ও বিজ্ঞাপন, পোশাকপরিচ্ছদ, ধোলাই ভাতা, আনুতোষিক, টিফিন ভাতা, ছুটি নগদায়ন, টেলিফোন, সেলফোন ভাতা, যাতায়াত ভাতা, যাতায়াত ব্যয় (স্থানীয়), সিএনজি/পেট্রল/মবিল, যানবাহন ভাড়া প্রভৃতি খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে বিজেসির আঞ্চলিক কার্যালয়ে গত ১৮ নভেম্বর সরেজমিন দেখা যায়, সেখানে কোনো কর্মকর্তা নেই। দুজন নিরাপত্তাপ্রহরী থাকার কথা থাকলেও তাঁদের দেখা পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকজন জানান, বিজেসির একজন কর্মকর্তা মাসে কয়েক দিন এ কার্যালয়ে আসেন।
কার্যালয়ের মূল ফটকে লেখা, এটি বিজেসির নিজস্ব সম্পত্তি। জমির পরিমাণ ১৮ দশমিক ৯৫ একর। তবে সেখানে উৎপাদনে থাকা উমেদা এসবি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রকৌশলী মো. আসলাম শেখ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, এই পুরো সম্পত্তিই বিজেসি বিক্রি করে দিয়েছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সম্পত্তিও হস্তান্তর করেছে তারা। এসব সম্পত্তির মধ্যে একটি অংশ প্রতিষ্ঠানগুলো রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে। বাকি সম্পত্তির রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়নি। কিনে নেওয়ায় এখানে উৎপাদনে থাকা গার্মেন্টসসহ ৮ থেকে ১০টি প্রতিষ্ঠানের একটিও ভাড়া দেয় না বিজেসিকে।
এ বিষয়ে বিজেসির চেয়ারম্যানের বক্তব্য চেয়ে ই-মেইল করা হয়। তবে তার উত্তর পাওয়া যায়নি।
একই দিন নারায়ণগঞ্জ নগরের কুলি রেলি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিজেসির শ্রমিকদের কোয়ার্টারগুলো এখন দোকানপাট হিসেবে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, এখানে বিজেসির দুজন নিরাপত্তাপ্রহরী ছিলেন। তবে কয়েক বছর আগে তাঁদের চাকরিচ্যুত করা হয়। তারপর থেকে সম্পত্তির পুরো দখল চলে যায় সেই সময়কার শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে।
সরকার যখন ঠিক করল যে এটা বিলুপ্ত করবে, তখনই এর সম্পত্তি কী হবে, কর্মকর্তা-কর্মচারীর কী হবে, তা ঠিক করার কথা। সিদ্ধান্তহীনতায় বিজেসির সম্পত্তির বিকল্প ব্যবহার হচ্ছে না। এতে সরকারের ক্ষতি, দেশেরও ক্ষতি।মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি
ঢাকার প্রধান কার্যালয় ও সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে বিজেসির আঞ্চলিক কার্যালয়ে ছাড়াও বিজেসির রংপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, চট্টগ্রামে আঞ্চলিক কার্যালয় আছে।
বিজেসির ময়মনসিংহ আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপকের অধীনে একজন অফিস সহকারী ও একজন নিরাপত্তাকর্মী আছেন।
বিজেসির চট্টগ্রাম কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে একজন কর্মকর্তা, দুজন কর্মচারী ও চারজন নিরাপত্তাকর্মী আছেন। জমি-গুদামসহ সম্পত্তি এখনো বিজেসির নিয়ন্ত্রণে আছে। এসব সম্পত্তি লিজ দেওয়া আছে।
বিজেসির রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়টি রংপুর শহরের গুপ্তাপাড়ায় অবস্থিত। এর ইনচার্জ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়া এই কার্যালয়ের অধীন উত্তরাঞ্চলের ১৪টি জেলা। এর আওতায় ১৭৫ একর জমি রয়েছে, যার অধিকাংশ বেদখলে। বিভিন্ন জেলায় ১৯টি গোডাউন রয়েছে। গোডাউনের ভাড়া বিজেসি পায়।
রংপুর কার্যালয়ে আছেন দুজন কর্মচারী, দুজন অফিস সহকারী ও দুজন দারোয়ান।
খুলনার দৌলতপুরের রেলিগেট কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে বিজেসির কোনো কর্মকর্তা বসেন না। একজন নিরাপত্তাপ্রহরী রয়েছেন সেখানে।
গোদনাইল বিজেসির আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভেতরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। সরেজমিনে দেখা যায়, ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিজেসি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বন্ধ। বিদ্যালয়টির চারপাশ ঘাসে ভরে গেছে। বিদ্যালয়ের মাঠ কারখানার কাপড় শুকানোর কাজে ব্যবহার হচ্ছে।
বিজেসির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, একটি অডিট আপত্তির ভিত্তিতে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো তিনজন স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক রয়ে গেছেন। তাঁদের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
স্থানীয় লোকজন জানান, বিদ্যালয়টি বিজেসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটি করোনার আগেও চালু ছিল। করোনার পর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও এটি আর খোলেনি। এই বিদ্যালয়ের দুই-তিন শ শিক্ষার্থী এখন অন্য বিদ্যালয়ে চলে গেছে।
এ বিষয়ে বিজেসির চেয়ারম্যানের বক্তব্য চেয়ে করা ই-মেইলের উত্তর পাওয়া যায়নি।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার যখন ঠিক করল যে এটা বিলুপ্ত করবে, তখনই এর সম্পত্তি কী হবে, কর্মকর্তা-কর্মচারীর কী হবে, তা ঠিক করার কথা। সিদ্ধান্তহীনতায় বিজেসির সম্পত্তির বিকল্প ব্যবহার হচ্ছে না। এতে সরকারের ক্ষতি, দেশেরও ক্ষতি। এটা ঠিক, ট্রানজিশনের জন্য একটা সময় লাগে। সেটা এক থেকে দুই বছর হতে পারে, কিন্তু তা তো ২৮ বছর হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, সরকারের এখন অন্তত সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন যে বিজেসিকে ফেলে না রেখে কীভাবে এর ব্যবহার করবে।
বিজেসির সম্পত্তির ব্যবহার কীভাবে হতে পারে, এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আদমজী পাটকলে আগে ২৩ হাজার মানুষ কাজ
করতেন। সেটিকে শিল্প পার্ক করার পর এখন সেখানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ কাজ করছেন। একইভাবে বিজেসির সম্পত্তিগুলোতেও সরকার বিভিন্ন ধরনের শিল্প পার্ক করতে পারে। শিল্প পার্ক করা হলে পণ্য উৎপাদন হবে, কর্মসংস্থান হবে, সরকারেরও আয় হবে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আরিফুল হক, রংপুর; জগলুল পাশা, ময়মনসিংহ ও সুজয় চৌধুরী, চট্টগ্রাম]