দীর্ঘ ২৬ মাস পর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আন্তদেশীয় যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হচ্ছে। ২৯ মে মৈত্রী ও বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেন দুটির চলাচল শুরু হবে। আর ১ জুন চালু হবে মিতালী এক্সপ্রেস। মৈত্রী এক্সপ্রেস ঢাকা-কলকাতার মধ্যে চলাচল করে। বন্ধন চলে খুলনা-কলকাতা পথে। আর মিতালী এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে নিউজলপাইগুড়ির পথে চলবে। এ পথে ট্রেন চলাচলের সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে চালু হতে পারেনি।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। দেশে করোনা সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর ২০২০ সালের ২৪ মার্চ থেকে সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে ১৫ মার্চ থেকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চলাচলকারী আন্তদেশীয় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সংক্রমণ কমায় মাঝে দেশের ভেতরে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হলেও আন্তদেশীয় ট্রেন চলাচল বন্ধই থাকে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ভারত সরকার ট্রেনের যাত্রীরা যেসব পথে যাতায়াত করেন, সেসব পথে ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। গত ২৮ এপ্রিল ঢাকা সফরে এসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছিলেন, শিগগিরই দুই দেশের মধ্যে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ট্রেনের যাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ট্রেন চালুর বিষয়েও দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ হতে থাকে। সর্বশেষ আজ বুধবার ভারতীয় রেলওয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ রেলওয়েকে চিঠি দিয়ে তিনটি ট্রেন চালুর তারিখ জানানো হয়। বাংলাদেশ রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ভারতের সঙ্গে ট্রেন চালুর দিন-তারিখ নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে মোটামুটি নিশ্চিত। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় নিয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করা হবে। আগামী রোববারই এ বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিচালন) সরদার সাহাদাত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ২৯ মে থেকে আন্তদেশীয় ট্রেন চালুর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এর জন্য আরও কিছু প্রস্তুতি বাকি আছে। এরপরই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে। রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, প্রথম দিন কলকাতা থেকে ঢাকার পথে মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল শুরু হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি ট্রেন (রেক) দিয়ে এর যাত্রা শুরু হচ্ছে। অন্যদিকে কলকাতা থেকে খুলনার পথে বন্ধন এক্সপ্রেস আসবে ভারতীয় রেলের একটি ট্রেন নিয়ে। মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনটি নিউজলপাইগুড়ি থেকে ঢাকার পথে আসবে ভারতের ট্রেন নিয়ে। রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মৈত্রী ও বন্ধন এক্সপ্রেস ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের ট্রেন দিয়েই চলাচল করবে। তবে মিতালী এক্সপ্রেসের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের পর্যাপ্ত কোচ নেই। এ জন্য প্রথমে ভারতের ট্রেন দিয়েই চলাচল করবে মিতালী এক্সপ্রেস।
ঢাকা-কলকাতার মধ্যে মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করছে ২০০৮ সাল থেকে। বন্ধ হওয়ার আগে বৃহস্পতিবার বাদে সপ্তাহের সব দিনই এই ট্রেন চলাচল করত। ২৯ মে থেকে আগের মতোই চলাচল করবে। বন্ধন এক্সপ্রেস চালু হয় ২০১৭ সালে। বাংলাদেশ থেকে বৃহস্পতি ও রোববার দুদিন এই ট্রেন ছেড়ে যাবে। ভারত থেকে আসবে দুদিন।
বাংলাদেশের চিলাহাটি এবং ভারতের হলদিবাড়ি সীমান্ত হয়ে ট্রেন চলাচল ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওই পথে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মালবাহী ট্রেন এবং ২০২১ সালের ২৭ মার্চ যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করেন। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এ পথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি। এ মাসের শেষ দিকে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম ভারতে সরকারি সফরে যাবেন। ওই সফরে দিল্লি থেকে ভারত ও বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী ভার্চ্যুয়ালি মিতালী ট্রেনের যাত্রা উদ্বোধন করবেন। ঢাকার সেনানিবাস স্টেশন ও ভারতের নিউজলপাইগুড়ির মধ্যে মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলাচল করবে। ঢাকা থেকে বৃহস্পতি ও সোমবার ট্রেন ছাড়বে। একইভাবে ভারত থেকেও দুদিন ট্রেনটি বাংলাদেশে আসবে।
মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য নতুন ভাড়ার হার ঠিক করেছে দুই দেশের রেলওয়ে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, মিতালী এক্সপ্রেসে ঢাকা থেকে নিউজলপাইগুড়ি পর্যন্ত এসি বার্থের ভাড়া হবে ৪ হাজার ৯০৫ টাকা। এসি সিটের ভাড়া ৩ হাজার ৮০৫ টাকা। আর এসি চেয়ারের ভাড়া ২ হাজার ৭০৫ টাকা।
মৈত্রী, বন্ধন, মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের আয় ভাগাভাগি করে নেবে বাংলাদেশ ও ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষ। মৈত্রী এক্সপ্রেসের ৭৫ শতাংশ আয় পায় বাংলাদেশ, ২৫ শতাংশ যায় ভারতে। বন্ধন এক্সপ্রেসের আয় ৫০ শতাংশ করে দুই দেশের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। আর মিতালী এক্সপ্রেস চালু হলে আয়ের ৮০ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ। ২০ শতাংশ পাবে ভারতীয় রেলওয়ে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে দুই দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন চালুর বিষয়ে ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষের মতামত চাওয়া হয়। জবাবে গত ১৫ মার্চ ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষ দুই দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরুর বিষয়ে সম্মতি জানায়। পাশাপাশি ভারত সরকারের কোভিড প্রোটোকলসংক্রান্ত একটি নির্দেশনা পাঠায়। এরপর ২০ মার্চ বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা করে। সভায় বাংলাদেশ রেলের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারতীয় সরকারের প্রোটোকল অনুসারে ভ্রমণকারীকে যাত্রার ৭২ ঘণ্টা আগে আরটিপিসিআর কোভিড টেস্ট কিংবা দুই ডোজ কোভিড টিকা গ্রহণের সনদ থাকতে হবে। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের সনদের প্রয়োজন নেই। তবে ৬-১২ বছর বয়সী ভ্রমণকারীদের কোভিড প্রোটোকল সম্পর্কে স্পষ্ট করা হয়নি। বাংলাদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কোভিড প্রটোকল ভারতের প্রটোকলের কাছাকাছি। তবে বাংলাদেশে ১২ বছরের কম বয়সী সবার টিকা কিংবা আরটিসিপিআর পরীক্ষা সনদে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, করোনা মহামারির পর ভারত কয়েক মাস সব ধরনের ভিসা দেওয়া বন্ধ রাখে। পরে শুধু বিমান পথে চিকিৎসার প্রয়োজনে ভ্রমণকারীদের ভিসা দেওয়া হয়। সড়ক ও রেলপথে ভিসা দেওয়া বন্ধই ছিল। এসব সমস্যা এবং করণীয় উল্লেখ করে ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষকে ২১ মার্চ চিঠি দেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের পর ভিসা জটিলতা কেটে যায়। তাতে দুই দেশের মধ্যে ট্রেন চালুর বিষয়ে বাধা কেটে যায়।