চার বছর আগে নির্মাণকাজ শেষ হলেও চিকিৎসার পরিবর্তে অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
১০ তলা ভিতের ওপর ৫ তলা হাসপাতালটি স্থাপন করা হয়েছিল আগুনে পোড়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সেবার জন্য। নির্মাণকাজও শেষ হয়েছিল চার বছর আগে। এখন সেখানে অগ্নিদগ্ধ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সেবা পাওয়ার কথা। সরকারের কাগজে–কলমেও লেখা আছে এটি একটি বার্ন হাসপাতাল। কিন্তু ভবনে ঢুকলেই দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সেখানে কোনো রোগী নেই, চিকিৎসক, নার্স কেউই নেই। জনগণের করের টাকায় বানানো হাসপাতালটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অফিস হিসেবে। এটি এখন ফায়ারম্যানদের ব্যবহারিক শ্রেণিকক্ষ।
সরকারের টাকায় বানানো হাসপাতালটির অবস্থান রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্সের ভেতরে। অগ্নিকাণ্ড কিংবা যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করার সময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আহত হলে তাঁদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে। পাঁচতলাবিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনের কাজ শেষ করে ২০১৭ সালের জুনে ফায়ার সার্ভিসের কাছে হস্তান্তর করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। একই সময়ে হাসপাতালের জন্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম, বার্ন উপকরণ, সার্জিক্যাল উপকরণ, ফার্নিচার কেনাকাটাও শেষ হয়। ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বার্ন ট্রিটমেন্ট হাসপাতাল’ শিরোনামের প্রকল্পটির আওতায় এসব কাজ করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২৪ কোটি টাকা।
বৃহৎ প্রকল্প বিশেষজ্ঞ ফাওজুল কবির খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালটি নির্মাণে শুরুতেই গলদ ছিল। তবে হাসপাতাল যেহেতু হয়ে গেছে, তাই এটিকে এখন অন্য কোনো হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া উচিত।
চার বছর আগে তৈরি করা হাসপাতালটি কেমন চলছে তা দেখতে গত ২৩ জুন ভবনে ঢুকতেই নিচতলায় চোখ আটকে গেল। হাসপাতালের নিচতলা পুরোটাই ব্যবহৃত হচ্ছে শ্রেণিকক্ষ হিসেবে। অথচ যেখানে এখন চিকিৎসা দেওয়ার কথা। দোতলায় দেখা গেল, কোটি কোটি টাকা খরচ করে কেনা স্বাস্থ্য সরঞ্জাম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এক রুমে অক্সিজেন সিলিন্ডার, এক্স-রে মেশিন পড়ে ছিল। আরেক রুমে পড়ে আছে ভেন্টিলেটরসহ অ্যানেসথেসিয়া মেশিন। অন্য এক রুমে আলট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি মেশিন, প্যাথলজি মেশিন স্তূপ করে ফেলে রাখা হয়েছে। তৃতীয় তলায় অপারেশন থিয়েটার দুটি। আর হাসপাতালের চতুর্থ ও পঞ্চম তলা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্সের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। হাসপাতালের পঞ্চম তলায় আলাদা একটি বার্ন ইউনিট তৈরি করা আছে।
প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, কেনা সরঞ্জামের মধ্যে আছে আইসিইউ বেড ৫টি, ৩০টির মতো জেনারেল বেড, রোগী টানার ট্রলি ৫টি, ৩০টি স্টিলের আলমারি, ওয়েটিং চেয়ার ৫০টি, হুইলচেয়ার ৫টি, মেডিসিন ট্রলি ৫টি, সেক্রেটারিয়েট টেবিল ও চেয়ার ১৫টি, খাদ্য সরবরাহের জন্য ৬টি ট্রলি, রোগীর পরীক্ষার বেড ৮টি, ২টি অপারেশন থিয়েটার, জরুরি ট্রলি বেড ২টি, ২০ সেট কম্পিউটার, কম্পিউটার টেবিল ২০টি, ৬টি ফটোকপি ও ফ্যাক্স মেশিন, এ ছাড়া বার্ন ইউনিটের জন্য বার্ন ট্যাংক, বার্ন ট্রলি ও ফিল্টার। আরও আছে বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল উপকরণ। তবে এগুলো আর কখনো ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, চার বছর আগে কেনা অনেক উপকরণের মেয়াদও পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে সিরিঞ্জ, হ্যান্ড গ্লাভস, ক্যাথিটার, ওয়াশ কীট, এক্স-রে ফিল্মের মতো উপকরণ। সব যন্ত্রপাতিই অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ব্যবহার না হওয়ায় এর ওপরে ধুলার আস্তরণ পড়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এই প্রকল্পের আওতায় ৩৩০ ধরনের যন্ত্রপাতি ও উপকরণ কেনা হয়েছে। যার মধ্যে অন্তত ৪৬টি যন্ত্রপাতি ও উপকরণের মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। বাকি যেসব যন্ত্রপাতি ও উপকরণ রয়েছে, সেগুলোও ব্যবহার না হওয়ায় ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বার্ন হাসপাতাল নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় যতটা মনোযোগী ছিলেন কর্মকর্তারা, জনবল নিয়োগের বিষয়ে ততটা মনোযোগী ছিলেন না কেউই। হাসপাতাল তৈরির কাজ শেষ হলে সেখানে চিকিৎসক ও নার্স আসবে কোত্থেকে, সেদিকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। হাসপাতাল নির্মাণ এবং যন্ত্রপাতি কেনাকাটা শেষ হলে তারপর জনবল নিয়োগের কাজ শুরু হয়। তারপরও চলে গেছে চারটি বছর। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত জনবল মেলেনি। ফলে হাসপাতালও চালু হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু করার জন্য তাঁরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৫২টি পদের বিপরীতে জনবল চেয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত জনবল মেলেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে রাজস্ব খাতের জন্য মাত্র ৩৮টি পদের ছাড়পত্র মিলেছে। সেটি এখনো প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় অনুমোদন মেলেনি। চিকিৎসক–নার্সসহ বিভিন্ন পদের বিপরীতে জনবল না পাওয়ার কারণেই হাসপাতাল চালু হয়নি।
অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশ পুলিশের অর্গানোগ্রামে চিকিৎসক–নার্সসহ বিভিন্ন পদের কথা উল্লেখ আছে। তেমনিভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবির অর্গানোগ্রাম হাসপাতাল পরিচালনার কাঠামো উল্লেখ আছে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অর্গানোগ্রামে হাসপাতাল পরিচালনার জন্য কোনো পদ নেই। ফলে এই হাসপাতাল পরিচালনা করতে জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়েছে।
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দুই বছর আগে এই বিভাগে যোগ দিই। আমি আসার আগেই হাসপাতাল ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটা হয়ে গেছে। এত দিনে হাসপাতালটি চালু হলে ভালো হতো। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেবা পেলে তাঁদের মনোবলও বাড়ত। কিন্তু সেটা হলো না।’ তিনি জানান, হাসপাতালটি চালু করার জন্য অর্গানোগ্রাম সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এর সুরাহা হবে।
হাসপাতালটি তৈরি করা হয়েছে পোড়া রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য। কিন্তু এখন সরকারি দপ্তরগুলোতে আলোচনা চলছে বার্ন নয়, বরং এটিকে জেনারেল হাসপাতাল হিসেবে চালু করতে। কারণ, রাজধানীতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট নামে একটি হাসপাতাল ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। সুতরাং নতুন করে আরেকটি বার্ন হাসপাতালের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।
হাসপাতালটি চালু করতে বেশ কিছু পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। সে ক্ষেত্রে হাসপাতালটি ৫০ বেডের করা হবে। এর মধ্যে ১০ শয্যা থাকবে আগুনে পোড়া রোগীদের জন্য। বাকি ৪০ শয্যা থাকবে জেনারেল হাসপাতালের জন্য।
জানতে চাইলে এই প্রকল্পের উদ্যোগী মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মোকাব্বির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বিভাগে আমি নতুন যোগ দিয়েছি। হাসপাতাল সম্পর্কে আমি খোঁজখবর নিয়েছি। আমরা চাই দ্রুত হাসপাতালটি চালু হোক। সে জন্য একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বার্ন হাসপাতাল হবে, না কি জেনারেল হাসপাতাল হবে, জনবল কীভাবে নিয়োগ হবে—এসব বিষয় তারা ঠিক করে প্রতিবেদন দেবে। সে আলোকে আমরা কাজ করব।’
মিরপুর ১০ নম্বরে ফায়ার সার্ভিসের জায়গায় যেখানে হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি আগে মাঠ ছিল। মাঠটি শিক্ষানবিশ ফায়ারম্যানদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হতো। ভবন নির্মাণের পর থেকে মাঠের আকার সংকুচিত হয়ে গেছে। এতে প্রশিক্ষণরত ফায়ারম্যানদের জন্য স্থান সংকুলান করা যাচ্ছে না। সে কারণে হাসপাতালটি এখন অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের দাবি, হাসপাতালটি বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিবর্তে জেনারেল হাসপাতাল করতে হবে। এর মাধ্যমে বেশি উপকৃত হবেন তাঁরা। কারণ, এতে তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও চিকিৎসা নিতে পারবেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, চার বছর ধরে একটা হাসপাতাল ও যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। অপরিকল্পিতভাবে হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়েছিল। চিকিৎসক, নার্সের নিশ্চয়তা না পেয়েই কীভাবে একটা হাসপাতাল হয়ে গেল? পরিকল্পনা ছাড়া কীভাবে প্রকল্পটি পাস হলো এবং অতি উৎসাহী কাদের কারণে অর্থের অপচয় হলো, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।