১ হাজার ৯২ দিন পর মুক্তি পেলেন জাহালম

দুই দিন পর নিরীহ জাহালমের কারা মেয়াদের তিন বছর পূরণ হবে। জাহালম গ্রেপ্তারের পর থেকে বড় ভাই দরিদ্র শাহানূর দিনের পর দিন আদালত থেকে কারাগার, কারাগার থেকে আদালত ঘুরে বেড়িয়েছেন। রোববার দুপুরে জাহালমের ভাই শাহানূর যখন সংবাদ পান জাহালমকে হাইকোর্ট মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তখন তিনি ছুটে আসেন কাশিমপুর কারাগারে। বিকেল চারটা থেকে কারাগারের ফটকে অপেক্ষা করতে থাকেন শাহানূর। তাঁর গায়ে কেবল একটি টি–শার্ট। রাত বাড়ার সঙ্গে শীতে কাঁপতে থাকেন শাহানূর। রাত ১০টার দিকে শাহানূর বলছিলেন, ‘আজ আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন।

কাশিমপুর কারাগার থেকে বিনা অপরাধে তিন বছর জেল খেটে বের হওয়ার পর জাহালমকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভাই শাহানূর। ছবি: দীপু মালাকার
কাশিমপুর কারাগার থেকে বিনা অপরাধে তিন বছর জেল খেটে বের হওয়ার পর জাহালমকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভাই শাহানূর। ছবি: দীপু মালাকার

আমার ভাই মুক্তি পাবে। ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি যাব।’ রোববার দিবাগত রাত একটার দিকে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন জাহালম। প্রায় নয় ঘণ্টা অপেক্ষার পর শাহানূর কাছে পেলেন ছোট ভাই জাহালমকে। আর জাহালম মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিলেন ১ হাজার ৯২ দিন পর।

জেল থেকে বের হয়ে কাশিমপুর কারাফটকে সাংবাদিকদের জাহালম বলেন, ‘কখনো বিশ্বাস করতে পারিনি ছাড়া পাব।’ বিনা দোষে জেল খাটতে হলো। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেন জাহালম। সে সময় হাইকোর্টকে ধন্যবাদ জানান জাহালম। একই সঙ্গে তিনি প্রথম আলো ও মানবাধিকার কমিশনকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন।  

জাহালম। ফাইল ছবি

কষ্টের দিনরাত্রি
জাহালমেরা তিন ভাই, তিন বোন। সবার বড় শাহানূর। যিনি একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। টাঙ্গাইলের নাগরপুরে ছোট একটি দোকান আছে। তাঁর তিন সন্তান। জাহালম নরসিংদীর একটি জুটমিলে চাকরি করতেন। স্ত্রী–সন্তান নিয়ে সেখানেই থাকতেন। জাহালমের মা মনোয়ারা অন্যের বাড়িতে কাজ করে আসছেন অনেক আগে থেকে। জাহালমের ছোট বোন তাসলিমার বয়স যখন তিন বছর (এখন বয়স ২৩ বছর) তখন বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। এরপর থেকে জাহালমের মা মনোয়ারায় সংসারের হাল ধরেন। তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করে তাঁর ছেলে মেয়েকে বড় করে তোলেন। জাহালমের বড় ভাই শাহানূর জানালেন, তাঁর মায়ের জন্মের সময় মারা যান তাঁর নানি। মা তখন পালক বাবার কাছে বেড়ে ওঠেন। সেই পালক বাবা মনোয়ারাকে বিয়ে দেন।

ছেলে জাহালমের কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদলেন মা মনোয়ারা বেগম। প্রথম আলো

৩০টি বছর পরের বাড়িতে থেকেছেন তাঁরা। সেখানে তাঁদের জন্ম, বেড়ে ওঠা। বছর কয়েক আগে ধারদেনা করে ১০ শতাংশ জায়গা কেনেন। সেখানে টিনের দোচালা দুটি ঘর তোলেন। জাহালমের মা মনোয়ারা প্রথম আলোকে জানান, জন্মের পর থেকে কষ্ট করে গেছেন। পরের বাড়িতে কাজ করে তাঁর সারাটা জীবন কাটছে। অনেক কষ্টে ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন। মনোয়ারা আরও জানালেন, যেদিন থেকে তাঁর ছেলে জাহালমকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হলো, সেদিন থেকে তাঁদের জীবনের আরেকটি চরম কষ্টের অধ্যায় শুরু হয়। বড় ছেলে শাহানূর জাহালমকে মুক্ত করার জন্য কষ্ট করে চলেছেন।

মনোয়ারা বললেন, মামলার শুনানির দিন থাকলে জাহালমকে দেখার জন্য টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার আদালতে যান তাঁর বড় ছেলে জাহালম। প্রায় শুনানির তারিখে তিনি অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করে আনেন। সেই টাকা নিয়ে শাহানূর জাহালমের কাছে ছুটে যান। এভাবে অনেকের কাছ থেকে সুদের টাকা নিয়েছেন, নিয়েছেন এনজিওর ঋণ। এখন প্রায় প্রতিদিন পাওনাদার বাড়িতে আসেন। একজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে আরেকজনকে দেন।

মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত
শাহানূর দুদকের কর্মকর্তাদের বারবার বলেছেন, তাঁর ভাই নিরপরাধ। কিন্তু কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি। সুদের টাকা নিয়ে ভাইকে মুক্ত করার জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন আইনজীবী। তাঁর ভাই জাহালম ও তাঁর আইনজীবী আদালতকে বারবার বলেছিলেন, জাহালম সালেক নন। তিনি নিরপরাধ। মেলেনি জাহালমের জামিন। নিরুপায় জাহালমের ভাই শাহানূর গত বছর যান মানবাধিকার কমিশনের কাছে। শাহানূরের অভিযোগ পেয়ে মানবাধিকার কমিশনার কাজী রিয়াজুল হক ছুটে আসেন কাশিমপুর কারাগারে। কথা বলেন জাহালমের সঙ্গে। তিনি নিশ্চিত হন, জাহালম তাঁতকলশ্রমিক। বাংলায় কোনোমতে স্বাক্ষর করতে জানেন। ব্যাংক জালিয়াতি মামলার আসামি সাগর আহম্মেদ তাঁকে জানান, প্রকৃত আসামি সালেককে তিনি চেনেন। মানবাধিকার কমিশন তখন আসামি সালেকের জীবনবৃত্তান্ত জানতে চেয়ে ঠাকুরগাও স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি লেখেন। একইভাবে কারাগারে থাকা জাহালমের জীবনবৃত্তান্ত জানতে চেয়ে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের প্রশাসনকে চিঠি লেখেন। স্থানীয় প্রশাসনের পাঠানো প্রতিবেদনে মানবাধিকার কমিশন নিশ্চিত হন, ব্যাংকের টাকা জালিয়াত চক্রের প্রকৃত আসামি সালেকের সম্পদ বেড়েছে। কিনেছেন জমিও। উল্টো দিকে জাহালমের পরিবার হতদরিদ্র। ভিটে ছাড়া আর কোনো জমি নেই। 

কারাফটকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জাহালম। ছবি: দীপু মালাকার

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের তদন্তে যখন জাহালম নিরপরাধ প্রমাণিত হন, তখন চিঠি দিয়ে দুদককে জানানো হয়। কথা বলেন দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে। অধিকতর তদন্ত করার অনুরোধ করেন।
দুদক অধিকতর তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়। দুদকের তদন্তে উঠে আসে, জাহালম নিরপরাধ। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য বিচারিক আদালতের কাছে আবেদন করেন। গত ৩০ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি সেদিন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। শুনানি নিয়ে আদালত জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করেন। একই সঙ্গে নিরীহ জাহালমের গ্রেপ্তারের ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্রসচিবের প্রতিনিধি ও আইনসচিবের প্রতিনিধিকে ৩ ফেব্রুয়ারি (আজ) সকাল ১০টায় সশরীরে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

শেষ পর্যন্ত অবসান হলো জাহালমের জীবনের এক করুণ অধ্যায়ের। বিনা অপরাধে তিন বছর জেলে থেকে গতকাল উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিন পেলেন তিনি। কাশিমপুর কারাগারের সামনে এই অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভাই শাহনূর। ছবি: দীপু মালাকার

এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে দুদকের মহাপরিচালক (তদন্ত), মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, স্বরাষ্ট্রসচিবের (সুরক্ষা) প্রতিনিধি যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন এবং আইনসচিবের প্রতিনিধি সৈয়দ মুশফিকুল ইসলাম আদালতে হাজির হন।

শুনানি নিয়ে সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির অভিযোগে দুদকের করা সব মামলা থেকে নিরীহ জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে আজই (গতকাল) মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ‘এক নির্দোষ লোককে এক মিনিটও কারাগারে রাখার পক্ষে আমরা না।’

একই সঙ্গে হাইকোর্ট এই ভুল তদন্তের সঙ্গে কারা জড়িত, তাঁদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। না হলে আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন বলে জানান।