সাভারের রানা প্লাজা ধসের এক বছর পরও আহত এক হাজার ৫৮ জন শ্রমিক কাজে যোগ দিতে পারেননি। কাজের প্রতি অনীহা চলে এসেছে সাড়ে ৭ শতাংশ শ্রমিকের।
কাজ না থাকায় আহত ৬৬ শতাংশ শ্রমিক এখন দৈনন্দিন জীবিকার চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর ২ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিক মোটেই তাঁদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে পারছেন না। আহত এক হাজার ৪৩৬ জন শ্রমিকের ওপর জরিপ চালিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এই শ্রমিকেরা এবং রানা প্লাজা ধসে নিহত ৭৮৬ জনের পরিবারসহ মোট দুই হাজার ২২২ জন শ্রমিকের ওপর এ মাসের শুরুতে জরিপটি চালায় বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ। জরিপ প্রতিবেদনটি গতকাল রোববার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে প্রকাশ করা হয়।
এ উপলক্ষে আয়োজিত সংলাপে উঠে আসে শ্রমিকদের দ্রুত ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি। বক্তাদের মতে, পোশাকমালিক, সরকার, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক তহবিলসহ নানা মাধ্যম থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু হলেও শ্রমিকদের একটি অংশ এখনো কোনো পক্ষ থেকেই ক্ষতিপূরণ পায়নি। এটি হয়েছে ক্ষতিপূরণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আইনি বাধ্যবাধকতা এবং এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা না থাকায়।
অনুষ্ঠানে জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন জরিপকারী দলের প্রধান আমানুর রহমান। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, আহত শ্রমিকদের ৬৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ এখনো নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। আঘাতগ্রস্ত (ট্রমা) ২৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এক বছরেও শারীরিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি ২২২ জন শ্রমিকের (১৫.৫%)। অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে ১৩০ জনের (৯%)। ২১ জন আছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। আর এক হাজার ৬৩ জনের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।
জরিপে অংশ নেওয়া এক হাজার ৪৩৬ জন আহত শ্রমিকের ৩৭৮ জন কাজে যোগ দিয়েছেন। ১৮২ জন আবারও পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন ৫৯ জন। অনিয়মিত দিনমজুর হয়েছেন ৪৭ জন। বাকিরা নানা কাজে যুক্ত হয়েছেন।
জরিপ অনুযায়ী, আহত ৫৮ শতাংশ শ্রমিক ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন। ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশের নিজস্ব কোনো সম্পত্তি নেই। আর ৯২ দশমিক ৮ শতাংশ শ্রমিকের কোনো জমানো টাকাই (সঞ্চয়) নেই।
জরিপ বলছে, নিহত শ্রমিকদের ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশের পরিবার তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। কিছু সমস্যায় পড়ছে ২৬ শতাংশ পরিবার। মোটেও চাহিদা মেটাতে পারছে না ৪ দশমিক ২ শতাংশ। ভালোভাবে চলছে ২ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার। আর ৫৫ শতাংশ পরিবারে গত এক বছরে নিরবচ্ছিন্নভাবে একই পরিমাণ আয় হয়নি।
জরিপে বলা হয়, রানা প্লাজার হতাহত শ্রমিকদের জন্য গঠিত প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমে পড়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত হতাহতদের দেওয়া হয়েছে ২২ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আওতায় গঠিত রানা প্লাজা ডোনার ট্রাস্ট ফান্ডে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে চার কোটি ডলারের তহবিল পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেড় কোটি ডলার পাওয়া গেছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রানা প্লাজায় থাকা নিউ স্টাইল গার্মেন্টসের শ্রমিক সজল দাস। একই কারখানায় কাজ করতেন তাঁর স্ত্রী, ভাই ও ভাবি। অনুষ্ঠানে সজল বলেন, ‘এখন একটানা কাজ করতে পারি না, কোমরে ব্যথা লাগে। আমি এখন বেকার। আমি আর আমার স্ত্রী বিকাশের (প্রাইমার্কের দেওয়া) ৯০ হাজার টাকা পাইছি। সেখান থেকে ৪০ হাজার টাকা শেষ। বাকি টাকা দিয়ে চলতাসি। বিকাশের টাকা ছাড়া আমি আর কোনো টাকা পাইনি।’
আলোচনা: সংলাপে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান হামিদা হোসেন বলেন, রানা প্লাজাকেন্দ্রিক কাজে আরও সমন্বয় প্রয়োজন। যাঁরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাঁরা সেটা পূরণ করছেন কি না, তা তদারকি করতে হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের বাকি টাকা কি ক্ষতিপূরণ নাকি মানবিক বিবেচনায় দেওয়া হবে—তা জনসাধারণকে জানানো দরকার।
সাংসদ শিরীন আখতার বলেন, ‘আমি আগেও কয়েকটি অনুষ্ঠানে আহতদের বলতে শুনেছি, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে টাকা পাচ্ছেন না। এটা কেন হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
অ্যাকশনএইডের এদেশীয় পরিচালক ফারাহ্ কবীর বলেন, ‘রানা প্লাজার ঘটনার পর পোশাকমালিক, ক্রেতা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। রানা প্লাজা ফান্ড আমরা করতে দেখেছি, কিন্তু তার লেনদেন এখনো দেখিনি। এক বছর অনেক সময়।’
আইএলওর এদেশীয় পরিচালক শ্রীনিবাস রেড্ডি বলেন, দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের দুই ধরনের সেবা প্রয়োজন হয়। একটি তাত্ক্ষণিক চিকিত্সা, অন্যটি দীর্ঘমেয়াদি সেবা। প্রথমটির ব্যাপারে রানা প্লাজার ঘটনার পর অনেক প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সেবার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে এখন নজর দিতে হবে। ক্ষতিপূরণ তহবিলগুলোর কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, সব উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। বেশি অভাব আইনি বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে। পোশাকমালিক ও ক্রেতারা আইনগতভাবে বাধ্য—এ মনোভাব নিয়ে কাজ করছে না। তিনি বলেন, ‘যিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাচ্ছেন, তিনিই আবার প্রাইমার্ক থেকে পাচ্ছেন, আইএলও থেকে পাচ্ছেন। কিন্তু যাঁরা পাচ্ছেন না, তাঁরা পাচ্ছেনই না।’
সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রানা প্লাজাকেন্দ্রিক অনেক উদ্যোগের ধারাবাহিকতা ছিল না। সে কারণেই যেসব শ্রমিক বিজিএমইএর কাছে গেছেন, তাঁরা চাকরি পেয়েছেন, কিন্তু যাঁরা যায়নি, তাঁদের কিছুই হয়নি।
আইএলও গঠিত রানা প্লাজা অ্যারেঞ্জমেন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটির নির্বাহী কমিশনার মুজতবা কাজাজি বলেন, রানা প্লাজায় হতাহত তিন হাজার ৬৩৯ জনকে দু-এক দিনের মধ্যে ৫০ হাজার টাকা করে অগ্রিম ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এর মধ্যে ৫৮০ জনকে ক্ষতিপূরণ দেবে প্রাইমার্ক। তিনি জানান, প্রত্যেক নিহত শ্রমিকের নামে একটি করে ব্যাংক হিসাব খোলার প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে তাঁদের ক্ষতিপূরণের টাকা জমা রাখা হবে। সেই টাকায় তাঁদের সন্তানদের পড়ালেখা চলবে।
ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশের মহাসচিব রায় রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘তাজরীনের ক্ষতিপূরণ এখনো হয়নি। রানা প্লাজার ঘটনা সেটাকে চাপা দিয়ে দিয়েছে। বলা যায় না, এর চেয়ে বড় ঘটনা ঘটলে রানা প্লাজাও আবার চাপা পড়ে যায় কি না।’
সংলাপে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান, বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রমুখ বক্তব্য দেন।