১৯৮ বছর পর...

বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ১৯৮ বছর পর খুঁজে পাওয়া গেল এ রকম প্রজাতির একটি অর্কিড

ডেনড্রোবিয়াম অ্যাঙ্গুল্যাটাম অর্কিডের ফুল

বাংলাদেশের বনবাদাড়ে ১৮৮ প্রজাতির অর্কিড জন্মে। এসব প্রজাতির মধ্যে ডেনড্রোবিয়াম গণের ২৭ প্রজাতির অর্কিড রেকর্ড করা হয়েছে। তবে অতীতে উদ্ভিদবিদ স্যার ডালটন হুকার এবং ডেভিড প্রেইনের ফ্লোরা অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া বেঙ্গল প্ল্যান্টস বইয়ে উল্লেখ করা অনেক প্রজাতির অর্কিড দ্বিতীয়বার দেখা যায়নি বাংলাদেশে। অনেক প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। সাধারণত অতীতে রেকর্ড করা কোনো প্রজাতি যদি ১০০ বছর পর খুঁজে পাওয়া যায়, সেসব প্রজাতিকে ‘রিডিসকভারি’ প্রজাতি হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ১৯৮ বছর পর খুঁজে পাওয়া গেল এ রকম প্রজাতির একটি অর্কিড। অর্কিড প্রজাতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Dendrobium angulatum। ১৮২১ সালে ডিসিলভা প্রজাতিটির নমুনা তত্কালীন ব্রিটিশ বেঙ্গল থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। সেই একমাত্র নমুনাটি সংগৃহীত আছে ইংল্যান্ডের কিউহার্বেরিয়ামে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বান্দরবানে পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে উদ্ভিদ গবেষক হিসেবে সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে গিয়ে বনের মধ্যে একটি কেটে ফেলা গর্জনগাছের কাণ্ডের সঙ্গে এই অর্কিড খুঁজে পাই। তখন কোনো ফুল ছিল না, তাই প্রজাতি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পাতার ভিন্নতা দেখে আমি কয়েকটি অর্কিড নমুনা কেটে ফেলা গর্জনগাছের কাণ্ডসহ সংগ্রহ করি পরবর্তী সময়ে পর্যবেক্ষণের জন্য। ঢাকায় নিয়ে এসে বাসার বারান্দায় আলো-বাতাসময় জায়গায় পরিত্যক্ত কাণ্ডসহ গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে রেখে প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। ২০১৯ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে এটিতে ফুলের মঞ্জরি আসে এবং ৪ এপ্রিল প্রথম ফুল ফোটে। ফুল ফোটার পর এটিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। ছয়টি ফুল ফোটে ক্রমান্বয়ে, কিন্তু মাত্র একটি ফুল থেকে একটি ফল আসে মে মাসে। এক মাস পর ফলটি পরিপক্ব হয়ে ফেটে গিয়ে সাদা পাউডারের মতো বীজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের মাধ্যমে।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম থেকে প্রকাশিত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্ভিদ নিয়ে মাঠপর্যায়ে জরিপ করা গবেষণাগ্রন্থ ভাস্কুলার ফ্লোরা অব চিটাগাং এন্ড চিটাগাং হিল ট্রাক্টস, ভলিয়ম-১ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে জরিপের সময় অর্কিডটি পাওয়া যায়নি। প্রজাতিটির বর্তমান অবস্থা অজানা। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অর্কিড নিয়ে প্রকাশিত একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে এটিকে দেশ থেকে সম্ভাব্য হারিয়ে যাওয়া প্রজাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তা ছাড়া ২০০৭ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের উদ্ভিদ এবং প্রাণী বিশ্বকোষ, ভলিয়ম ১২ গ্রন্থে এটিকে মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রজাতিটি বাংলাদেশে পুনরাবিষ্কার নিয়ে আমাদের একটি প্রবন্ধ ট্রপিক্যাল প্ল্যান্ট রিসার্চ নামক আন্তর্জাতিক পিয়ার রিভিউড জার্নাল–এ প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। প্রবন্ধটির সহযোগী লেখক হিসেবে আমার সঙ্গে আছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব এবং পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কবির বিন আনোয়ার এবং বাংলাদেশ জাতীয় হার্বেরিয়ামের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবা সুলতানা।

২০১৯ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে এটিতে ফুলের মঞ্জরি আসে এবং ৪ এপ্রিল প্রথম ফুল ফোটে। ফুল ফোটার পর এটিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়

বাংলাদেশ ছাড়া এ অর্কিড মিয়ানমার, ভারতের আসাম, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ড থেকে রেকর্ড করা হয়েছে। এটি মূলত বৃষ্টিবহুল চিরহরিৎ বনের বড় গাছের কাণ্ডে ও শাখায় জন্মে। এটি পরাশ্রয়ী বিরুত। কাণ্ডের দৈর্ঘ্য ৪০ থেকে ১০০ সেমি। প্রতিটি শাখায় সর্বোচ্চ ১২টি পাতা থাকে। পাতা প্রশস্তভাবে সজ্জিত। ফলক রেখাকার থেকে আয়তাকার। পুষ্পমঞ্জরি একক পুষ্পযুক্ত। বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে ফুল ধরে। এরা প্রায় ৯০০ মিটার উচ্চতায় জন্মাতে পারে। তবে সাঙ্গু বনের যেখানে পাওয়া গেছে, সে জায়গাটি সমুদ্রের সমতল থেকে ২৪৭ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।

প্রজাতিটির উদ্যানতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে। প্রজাতিটির কোনো ইংরেজি নাম জানা নেই। বাংলা নামও নেই। বাংলাদেশে অর্কিড প্রজাতি নিয়ে মাঠপর্যায়ে জরিপ ও গবেষণা করা দরকার।