নবম পর্ব

১৯৭১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গণহত্যা

দেশের বধ্যভূমিগুলো থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ছবি: ফাইল ছবি
দেশের বধ্যভূমিগুলো থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ছবি: ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়। এটা বিশ্বের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড চলে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে ১ হাজারের ওপর। বধ্যভূমি থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ৬৪ জেলার গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরে সংক্ষিপ্তভাবে বিবরণের ধারাবাহিক থাকবে প্রথম আলো নাগরিক সংবাদে। আজ থাকছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

রেহাইচর বধ্যভূমি ও গণকবর
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের অদূরে রেহাইচর গ্রামে ছিল বধ্যভূমি ও গণকবর। একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয় এখানে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গণকবরটি আবিষ্কৃত হয়েছে।

শ্মশানঘাট বধ্যভূমি, শিবগঞ্জ
মহানন্দা নদীর তীরবর্তী নবাবগঞ্জ শ্মশানঘাট ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম বধ্যভূমি। শহরের বহু তরুণ ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক মানুষকে এখানে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বুলেট যাতে খরচ না হয়, সে জন্য জবাই করেও বহু মানুষকে হত্যা করা হয়। তারপর সেসব মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

বারোঘরিয়া গণকবর
নবাবগঞ্জ সদর থানার বারোঘরিয়া ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন প্রাচীন জমিদার কাচারীবাড়ির সামনের বটগাছের নিচে মুক্তিযুদ্ধের সময় অগণিত মানুষকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার দল হত্যা করে। নিহত ব্যক্তিদের বটগাছের পার্শ্ববর্তী গর্তে (আয়তনে প্রায় এক বিঘা) ফেলে মাটিচাপা দিত তারা।

রহনপুর স্টেশনপাড়া বধ্যভূমি ও গণকবর
গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেনাছাউনি গড়ে তুলেছিল। এখানে তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে রাখত এবং তাদের রহনপুর স্টেশনসংলগ্ন এলাকায় নিয়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করত।

রহনপুর পুনর্ভবা নদী বধ্যভূমি
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর এ বি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের পেছনে পুনর্ভবা নদীর তীর ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম বধ্যভূমি।

গোমস্তাপুর গণকবর
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানাসংলগ্ন খালের পাড়ে এই গণকবর। এখানে সংঘটিত বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একাত্তরের ২৩ এপ্রিলের ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। সেদিন বেলা একটায় হানাদার বাহিনী থানাসংলগ্ন হিন্দুপাড়ায় অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে সব ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ৩৫ জনকে ধরে নিয়ে উল্লেখিত স্থানে লাইন করে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজার বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। ছবি: ফাইল ছবি


ইপিআর ক্যাম্প বধ্যভূমি
চাঁপাইনবাবগঞ্জের তৎকালীন ইপিআর বহিনীর ৬ নম্বর উইং হেডকোয়ার্টারের পেছনের দিকে মহানন্দা নদীর ধারে বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে।

বোয়ালিয়া গণকবর
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সমর্থকেরা গোমস্তাপুর থানার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের গৌরীপুর, দরবারপুর, ঘাটনগর, লক্ষ্মীনারায়ণপুর, নওদাপাড়া, বৌরতলী, কাঞ্চনতলা, বঙ্গেশ্বরপুর, চকমজুমদার, নরশিয়া, পলাশবনি, সাহাপুর, আলমপুর ও বোয়ালিয়া গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে ১৫২ জন নরনারীকে হত্যা করে।

পোড়াগ্রাম গণকবর
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নের পোড়াগ্রাম ও দশরশিয়া গ্রামে দুটো গণকবর রয়েছে। ১৯৭১ সালের মধ্য-নভেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনী ওই গ্রামে আক্রমণ চালায়। হামলায় গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর এই আক্রমণ ছিল আকস্মিক।

কাশিমপুর বধ্যভূমি
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাশিমপুর ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আরেকটি বধ্যভূমি। এখানে তারা বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য লোককে ধরে এনে হত্যা করে।

দোবশিয়া গ্রাম বধ্যভূমি
চাঁপাইনবাবগঞ্জের দোবশিয়া গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য লোককে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে।

কালুপুর বধ্যভূমি
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কালুপুর ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি বধ্যভূমি।

সোনামসজিদ গণকবর
শিবগঞ্জ থানার গৌড়ের ঐতিহ্যবাহী ছোট সোনামসজিদ ও দাখিল দরওয়াজা সীমান্তের মধ্যবর্তী স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অসংখ্য মানুষ নিহত হন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এই গণকবরটি আবিষ্কৃত হয়।

*১০ ডিসেম্বর ২০১৯ পড়ুন: ১৯৭১ সালে জামালপুর ও ময়মনসিংহ গণহত্যা
*চাঁপাইনবাবগঞ্জ আরও যদি গণহত্যা, গণকবর কিংবা বধ্যভূমিসংক্রান্ত খবর থাকে, অনুগ্রহ করে মেইলে জানাবেন

আবু সাঈদ: কবি, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
abusayedone@gmail.com

আরও পড়ুন:
প্রথম পর্ব : পঞ্চগড়–ঠাকুরগাঁওয়ে গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর
দ্বিতীয় পর্ব: দিনাজপুর ও নীলফামারীর গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর
তৃতীয় পর্ব : রংপুর ও কুড়িগ্রামে ১৯৭১ সালে গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর
চতুর্থ : মুক্তিযুদ্ধে লালমনিরহাট ও গাইবান্ধায় গণহত্যা

পঞ্চম পর্ব : মুক্তিযুদ্ধে জয়পুরহাট ও বগুড়ার গণহত্যা ও গণকবর
ষষ্ঠ পর্ব :মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহীর গণহত্যা ও বধ্যভূমি
সপ্তম পর্ব :মুক্তিযুদ্ধে নওগাঁ ও নাটোরের গণহত্যা, বধ্যভূমি
অষ্টম পর্ব: ১৯৭১ সালে সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় গণহত্যা