সাইমন ড্রিংয়ের লেখা

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ৫০ বছর

একাত্তরের ৬ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর প্রতিবেদক ২৬ বছরের সাইমন ড্রিং এসেছিলেন ঢাকায়। ২৫ মার্চের কালরাতে অস্ত্রের মুখে বিদেশি সাংবাদিকদের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আটকে রাখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পরদিন তাদের পাঠিয়ে দেয় করাচি। এ সময় সেনাবাহিনীর তল্লাশি এড়িয়ে হোটেলের ছাদে লুকিয়ে ছিলেন সাইমন ড্রিং। থেকে যান ঢাকায়। তিনি প্রত্যক্ষ করেন পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আর সেই সময়ের জ্বলন্ত ঢাকা। পরে ২৯ মার্চ ব্যাংককে পৌঁছে ডেইলি টেলিগ্রাফ–এ একটি মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন পাঠান এই তরুণ সাংবাদিক। ৩০ মার্চ প্রকাশিত সাইমন ড্রিংয়ের সেই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিশ্ববাসী প্রথম বিশদভাবে জানতে পারে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম গণহত্যার বিবরণ। সেই ঐতিহাসিক প্রতিবেদন লেখার প্রেক্ষাপট নিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রথম আলোর সুবর্ণ স্বাধীনতা সাময়িকীর জন্য লিখেছিলেন সাইমন ড্রিং। প্রথম আলোতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এটিই তাঁর শেষ লেখা। সাইমন ড্রিং গত শুক্রবার মারা গেছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—

সাইমন ড্রিং
সাইমন ড্রিং

মানুষের জীবনে সত্যিকার অর্থে স্পষ্টভাবে মনে রাখার মতো গভীর অনুভূতির মুহূর্ত কমই আসে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখে ঢাকার রাতটা ঠিক তেমন, একদিকে আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক সময়ের একটি, আরেক দিকে আমার সাংবাদিকতা পেশার কর্মবহুল এক অধ্যায়।

৫০ বছর পরে, আজও সেই ভয়াবহ রাতের শব্দ আর দৃশ্যগুলো, আমি যেসবের সাক্ষী, আমাকে এমন করে তাড়া করে ফেরে যেন তারা সেই সেদিনের মতোই স্পষ্ট।

২৫ মার্চ বিকেলে আমি শদুয়েক বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে হোটেলে (তখনকার দিনের ইন্টারকন্টিনেন্টাল) আটকা পড়েছিলাম। ঢাকায় সেদিন কারফিউ জারি হলো, আর তারপর সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছিল।

রাত ১১টা বাজার খানিক আগে দেখলাম পাকিস্তানি কিছু ট্যাংক আর ট্রাক ভরে সৈন্য শহরের ভেতরের দিকে যাচ্ছে। যেতে যেতে হোটেলে সামনের রাস্তার বানানো বাধাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল। মধ্যরাতের সামান্য পরেই আমি সেনাবহরের বাতি জ্বলা-নেভা দেখতে পেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে বন্দুক আর মেশিনগানের গগনবিদারী আওয়াজ আসতে লাগল। ভোরের সামান্য আগে আকাশ আগুনের হলকায় জ্বলে উঠল, যে আগুন তখন পুরো শহরটাকে পুড়িয়ে ফেলছিল।

তারপরের কতকগুলো দিনে, আমি যখন বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য সেনাবাহিনীর তৈরি করা ঘেরাটোপ গলে বেরোতে পারলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে, ছাত্রাবাসের বাইরে আর চত্বরে যত্রতত্র গুলি খাওয়া ছাত্রের লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। রাস্তায় দেখলাম গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া রিকশাওয়ালার রক্তে ভেসে যাওয়া নির্জীব শরীর। কিছু পরিবারকে দেখলাম নিজ বাড়িতে পুড়ে কয়লা হয়ে পড়ে আছে। বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামের সমাপ্তি আনতে ২৫ ও ২৬ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে সুচিন্তিত হত্যাযজ্ঞ চালায়, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় তার যতটুকু কথায় প্রকাশ করা যায়, তার চেয়ে আমি অনেক বেশি প্রত্যক্ষ করেছি।

বাঙালিদের মধ্যে যাদের সঙ্গে তখন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল, তাদের ক্রোধ আর উৎকণ্ঠা আমার পরিষ্কার মনে আছে। আমি জানতাম, যে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী ও বুদ্ধিজীবী আমাকে উথালপাতাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিটি বুঝতে ও তা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে সহায়তা করছিলেন, তাঁরাই তখন শত্রুর লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাসংগ্রামের ডাক দিয়ে প্রেরণাদায়ক ও ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তাঁর পরিস্থিতি তখন একই। ২৫ মার্চে রাত একটার ঠিক আগে আগে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি যদি আত্মগোপন করি, তারা আমাকে খুঁজতে গিয়ে পুরো ঢাকা শহরে আগুন লাগিয়ে দেবে।’

মনে আছে, আমার কতটা রাগ হয়েছিল ২৬ মার্চে সকাল সকাল যখন জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দেখেছিলাম। প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় তিনি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের একটা স্যুইটে অবস্থান করছিলেন। আশঙ্কায় আচ্ছন্ন মুখে তিনি ক্রমাগত ধূমপান করছিলেন। হয়তো নিজের জীবনের পরিণতি নিয়ে হতাশাগ্রস্ত, অন্যদিকে, ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়েও চরম দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। (তবে পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে নিজের আগ্রহে খবরের কাগজের প্রতিনিধিদের কাছে বলেছিলেন, ‘বিধাতাকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান সুরক্ষিত আছে।’)

মনে আছে, কতটা বিরক্তি আর রাগ হয়েছিল যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা, মেজর সিদ্দিক সালিক হোটেলে এসে প্রত্যেক বিদেশি সাংবাদিককে ওই রাতেই দেশ ছাড়তে উপদেশ দিয়ে গেলেন। বুঝতে বাকি ছিল না যে কারফিউ উঠিয়ে দেওয়ার পরে শহরের অবস্থা আমরা যেন দেখতে বা সে বিষয়ে প্রতিবেদন করতে না পারি, সেই চেষ্টাতেই এ আদেশ। অবশ্য তিনি বলেছিলেন ওটা আদেশ নয়, বরং আমাদের নিরাপত্তার খাতিরে নেওয়া সিদ্ধান্ত। আমি যখন তার সিদ্ধান্তের বিপরীতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললাম যে আমি ঢাকা শহরে থেকে যেতে চাই, মুখে একটা ক্রূর হাসি টেনে এনে তিনি জানালেন, ‘নিশ্চয়, আপনি চাইলে অবশ্যই থাকবেন। তবে সে ক্ষেত্রে আপনার জন্য এক বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করা হবে।’

বুঝেশুনে নিয়ে আমি থেকে গেলাম। তখন এই শহরে কী তাণ্ডব চলছিল তা আমাকে প্রকাশ করতেই হবে। ২৭ মার্চ সকালে বিদেশি সাংবাদিকদের নিয়ে ট্রাক বিমানবন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত হোটেলের ছাদে শীতাতপনিয়ন্ত্রণের প্রধান যন্ত্রটার পেছনে আমি লুকিয়ে থাকলাম। পরে জানতে পারলাম তরুণ ফ্রেঞ্চ চিত্রগ্রাহক মিশেল লরেন্ট হোটেলের আলমারির মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন।

তবে পরের তিন দিন সেনাসদস্যদের অগোচরে লুকিয়ে থাকাটা সম্ভব হয়েছিল কেবল হোটেলের সাহসী কিছু কর্মচারীর কারণে। তাঁরা কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। পরের তিন দিন যতবার সেনাসদস্যরা হোটেলে এসে পই পই করে আমাদের খুঁজেছে, কর্মচারীরা আমাদের লুকিয়ে রেখেছিলেন। এমনকি একটা পুরোনো গাড়িতে করে আমাদের শহর ঘুরিয়ে এনেছিলেন, যেন হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য আমরা ধারণ করতে পারি।

আমার প্রতিবেদন ও মিশেলের তোলা ছবি, দুইয়ে মিলে সেই প্রথম মার্চের কালরাতে কী হয়েছিল, সে সত্য প্রকাশ করল।

কিন্তু আমি বড় এক ভুল করে বসলাম। প্রতিবেদনে লিখে ফেললাম যে কেবল ঢাকাতেই অন্তত সাত হাজার মানুষের মৃত্যুর ভয়াবহতার কারণে বাংলাদেশে স্বাধীনতার সংগ্রাম হয়তো মাঝপথেই শেষ হয়ে যাবে। আমার ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছিল। সত্যিকার অর্থে হোটেলের যে লোকগুলো আমাকে লুকিয়ে রেখে আশাতীত সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের মানসিক শক্তির কথা আমি ভাবতে পারতাম। আমার বোঝা উচিত ছিল যে সংগ্রামের পথে সাধারণ বাঙালির যে মনোবল ও ক্ষমতা তা তখনো অটুট ছিল। প্রকৃতপক্ষে ওটাই ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে স্বাধীনতাসংগ্রামে জয়ী হওয়ার প্রধান কারণ।
১৫ মার্চ ২০২১