১৯৭১ সালের ময়মনসিংহ ও জামালপুরের গণহত্যা, গণকবর ও বধ্যভূমি

দেশের বধ্যভূমিগুলো থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ছবি: ফাইল ছবি
দেশের বধ্যভূমিগুলো থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ছবি: ফাইল ছবি
>

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়। এটা বিশ্বের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড চলে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে ১ হাজারের ওপর। বধ্যভূমি থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ৬৪ জেলার গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণের ধারাবাহিক থাকবে প্রথম আলো নাগরিক সংবাদে। আজ থাকছে ময়মনসিংহ ও জামালপুরের গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

ময়মনসিংহ
বড়বাজার কালীবাড়ি বধ্যভূমি
ময়মনসিংহ শহরের বড় বাজারের কালীবাড়িতে একটি কক্ষে পাওয়া যায় চওড়া দুটি কাঠের টুকরা, যাতে চাপ চাপ রক্তের চিহ্ন ছিল। ধারণা করা হয়, এই কাঠের টুকরার ওপর রেখেই হতভাগ্য বাঙালিদের জবাই করে হত্যা করা হতো। কালীবাড়ির পাশে ছিল দুটি কুয়ো। সেখানে মানুষের লাশে ভরা ছিল। ৫০০–এর অধিক মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়।

ডাকবাংলো বধ্যভূমি
ময়মনসিংহের ডাকবাংলোতে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে পরিচালিত হতো হত্যাকাণ্ড। স্বাধীনতার পরে ডাকবাংলোর পাশে নদীর ধারে পাওয়া গেছে অসংখ্য নরকঙ্কাল ও মাথার খুলি।

কেওয়াটখালি রেলওয়ে কলোনি বধ্যভূমি
ময়মনসিংহ কেওয়াটখালি রেলওয়ে কলোনিতে বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়।

নিউমার্কেট বধ্যভূমি
ময়মনসিংহ নিউমার্কেটের বধ্যভূমিতে অসংখ্য বাঙালিকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা কর হয়। স্বাধীনতার পর এখানে শত শত মানুষের নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে।

ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের কাছারিঘাট বধ্যভূমি
ময়মনসিংহের কাছারিঘাটের বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর অধিকাংশ লাশ ব্রহ্মপুত্র নদে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজার বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। ছবি: ফাইল ছবি


সাহেবপাড়া বধ্যভূমি
ময়মনসিংহ শহরের সাহেবপাড়া কোয়ার্টারের একটি পুকুর থেকে বাক্সভর্তি নরকঙ্কাল পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি বাহিনী স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজয়ের শেষ মুহূর্তে শহর ছেড়ে যাওয়ার আগে লাশগুলোকে টুকরা টুকরা করে বাক্সে ভর্তি করে পুকুরে ফেলে দেয়।

শালীহর গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২১ আগস্ট ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার শালীহর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যায় ১ জন মুসলমান ও ১৩ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ মে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মধুসূদন ধরকে শালীহর গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। ২১ আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী একটি বিশেষ ট্রেনে কিশোরগঞ্জ যাওয়ার পথে বিসকা রেলওয়ে স্টেশনে নেমে পড়ে। তৎকালীন বিসকার রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার সলিম উদ্দিন (অবাঙালি) এবং আলবদর কমান্ডার আব্দুল মান্নান ফকিরের নেতৃত্বে উপজেলার হিন্দুঅধ্যুষিত শালীহর গ্রামে হানা দিয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও তাণ্ডব চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। গুলি করে হত্যা করে ১ জন মুসলমানসহ ১৩ জন হিন্দুকে। গুলির মুখ থেকে কলেমা পাঠ করে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান নগেন্দ্র চৌকিদার। তবে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায় গ্রামের বাসিন্দা ছাবেদ আলী ব্যাপারীকে। গ্রামে ঢুকেই পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমে গুলি করে হত্যা করে নিরীহ কৃষক নবর আলীকে। এরপর একে একে হত্যা করে মোহিনী মোহন কর, জ্ঞানেন্দ্র মোহন কর, যোগেশ চন্দ্র বিশ্বাস, কিরদা সুন্দরী, শচীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, তারিনীকান্ত বিশ্বাস, দেবেন্দ্র চন্দ্র নম দাস, খৈলাস চন্দ্র নম দাস, শত্রুগ্ন নম দাস, রামেন্দ্র চন্দ্র সরকার, অবনী মোহন সরকার, কামিনী কান্ত বিশ্বাস, রায়চরণ বিশ্বাসকে।

জামালপুর
জামালপুর শহরের গণহত্যা
জামালপুর শহরে ২২ এপ্রিল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী জামালপুর শহরে প্রবেশ করে। প্রবেশকালে দিগপাইত থেকে পাথালিয়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার রাস্তার দুপাশের দোকানপাট, বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়, ভেঙে দেয় মন্দির আর প্রতিমা। গোলাগুলিতে মন্দিরের পুরোহিত, ছাত্রনেতা আবদুল হালিমসহ হত্যা করা হয় ৭০-৭২ জন নিরস্ত্র মুক্তিকামী মানুষকে।

শহীদ নগর গণহত্যা
সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের বারইপটল ও ফুলদহেরপাড়া গ্রামে ১৯৭১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ ছাড়া ৬০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যাসহ শত শত মানুষকে আহত করে হানাদার ও স্থানীয় রাজাকার আলবদররা।

বকসীগঞ্জ গণকবর
জামালপুরের বকসীগঞ্জ ইউনিয়নে অনেক গণকবর পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালে কয়েকটি গণকবর থেকে লাশগুলো তুলে দাফন করা হয়। এসব কবর থেকে ৫০-৬০টি করে লাশ তোলা হয়। আরও কয়েকটি গণকবর দুর্গন্ধের কারণে সে সময় খোঁড়া যায়নি।

শ্মশানঘাট বধ্যভূমি
জামালপুরের শ্মশানঘাটে চলত নিয়মিত গণহত্যা। এখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার দোসররা মিলে বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালিদের ধরে আনত এই শ্মশানঘাটে পরে তাঁদের গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, রাজাকার, আলবদরের হাতে নিহত জামালপুরের কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। ছবি: ফাইল ছবি


পিটিআই ক্যাম্প বধ্যভূমি
জামালপুরের পিটিআই ক্যাম্পে শান্তি কমিটির সহযোগিতায় বিভিন্ন জায়গা থেকে নিরীহ বাঙালিদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে কখনো গুলি করে, আবার কখনো জবাই কিংবা আঘাত করে হত্যা করা হতো।

কলেজ ক্যাম্প বধ্যভূমি
জামালপুরের কলেজ ক্যাম্পে রাজাকাররা অসংখ্য নিরস্ত্র-নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে আসত। তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হতো।

রশিদপুর ঘাট বধ্যভূমি
জামালপুরে রশিদপুর ঘাটের বধ্যভূমিতে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়।

শেরপুর কবরস্থান নদীর ঘাট বধ্যভূমি
জামালপুরের শেরপুরের কবরস্থানের নিকট নদীর ঘাট বধ্যভূমিতে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়।

ইসলামপুর গোয়ালার ঘাট বধ্যভূমি
জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার গোয়লার ঘাটের বধ্যভূমিতে বহু নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয়।

বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট বধ্যভূমি
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাটে অসংখ্য মানুষকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়।

পিয়ারপুর কবরস্থান বধ্যভূমি
জামালপুরের পিয়ারপুর কবরস্থানের নিকট নদীর ঘাটের বধ্যভূমিতে অনেককে হত্যা করা হয়।

আশেক মাহমুদ কলেজ হোস্টেল বধ্যভূমি
জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের স্নাতক হোস্টেল ছিল আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প। এখানে বহু লোককে ধরে এনে কলেজ এলাকাতেই জবাই করে হত্যা করে।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ’৭১-এর গণহত্যা ’৭১ সম্পাদিত আবু সাঈদ; দৈনিক পূর্বদেশ, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ- ডা. এম এ হাসান, পৃ.- ৩৭০ একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর- সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.- ১০৪ , দৈনিক বাংলা, ১০ মে ১৯৭২ যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ- ডা. এম এ হাসান, পৃ.- ৩৭২, দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ -ডা. এম এ হাসান, পৃ.- ৩৭১-৩৭২ . ভোরের কাগজ, ২১ আগস্ট ২০১৯।

আবু সাঈদ: কবি, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
abusayedone@gmail.com

* ১২ ডিসেম্বর পড়ুন: ১৯৭১ সালে কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার গণহত্যা

* ময়মনসিংহ ও জামালপুরের আরও যদি গণহত্যা, গণকবর কিংবা বধ্যভূমিসংক্রান্ত খবর থাকে, অনুগ্রহ করে মেইলে জানাবেন