কুমিল্লা নগরের নানুয়া দিঘিরপাড়ে পূজামণ্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে নানুয়া দিঘিরপাড়ের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা কুমিল্লার শিশু সংগঠক ও ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
প্রথম আলো: কুমিল্লার পূজামণ্ডপে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পেছনের কারণ কী হতে পারে?
আহসানুল কবীর: কুমিল্লার পূজামণ্ডপে অপ্রীতিকর ঘটনা ও হামলার ঘটনাটি মোটেও বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটা জাতীয় রাজনীতির পরিকল্পিত ইস্যু বলে আমি মনে করি। এটাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নানুয়া দিঘিরপাড়ে ৭০০ বছর আগে থেকে হিন্দুরা বসবাস করছেন। মুসলমানেরা এরপর এখানে বসতি স্থাপন করেন। এই এলাকায় আগে থেকে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি আছে। আমরা একে অন্যকে সহযোগিতা করি। উৎসবে সবাই একসঙ্গে জড়ো হই। এবার সব ফিকে হয়ে গেছে।
প্রথম আলো: পূজামণ্ডপে হামলা ও পরবর্তী ঘটনাগুলো সহজে রোধ করা গেল না কেন?
আহসানুল কবীর: নানুয়া দিঘিরপাড়ের পূজামণ্ডপটি অস্থায়ী। এখানে ২০০১ সাল থেকে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবার এই পূজামণ্ডপে কোনো ধরনের সিসি ক্যামেরা ছিল না। পুলিশও কম ছিল। পূজামণ্ডপ থেকে পবিত্র কোরআন উদ্ধারের পর ঘটনাস্থলে পুলিশ আসতে দেরি করেছে। প্রশাসন কঠোরভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়নি। এখানে পুলিশের গাফিলতি ছিল। পুলিশ চাইলেই দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত। কিন্তু এখানে উত্তেজিত জনতা বিক্ষোভ করার সুযোগ পায়। এতে কোনো ধর্মীয় নেতারা ছিলেন না। ১৮ থেকে ৩২ বছর বয়সী যুবকেরা ছিলেন, যাঁদের বেশির ভাগই অচেনা।
প্রথম আলো: নানুয়া দিঘিরপাড়ে অনেক স্বনামধন্য লোকের বসবাস। এই এলাকার সাংস্কৃতিক মানও বেশ ভালো। এই এলাকাকে অগ্রসরমান এলাকা বলা হয়। এখানকার বাসিন্দা হিসেবে পুরো ঘটনাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আহসানুল কবীর: এ জেলার প্রথম গ্র্যাজুয়েট মোহিনী মোহন বর্ধন। তিনি ১৮৬৩ সালে বিএ পাস করেন। এখানে ভাষাসৈনিক অজিত কুমার গুহের বাড়ি। বিশিষ্ট আইনজীবী ও জমিদার অনঙ্গ নাহার বাড়ি। প্রয়াত মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন বীর প্রতীকের বাড়ি। কাছেই উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মনের বাড়ি ও নবাববাড়ি। এত গুণীজনের এলাকায় এই ঘটনা ঘটেছে, আমরা লজ্জিত। কোনোভাবেই এটি মানতে পারছি না। আমার মতে, সড়কের পাশে নিরাপত্তাহীন পূজামণ্ডপ হওয়ায় খুব সহজেই এখানে কাজটি করেছেন দুর্বৃত্তরা। যে বা যাঁরা কাজটি করেছেন, তাঁরা রেকি করেই কাজটি করে পুরো দেশকে অস্থিতিশীল করছেন।
প্রথম আলো: নানুয়া দিঘিরপাড়ের ঘটনার পর অন্যান্য মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। পুরো নগরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। কারা এর পেছনে দায়ী বলে আপনি মনে করেন?
আহসানুল কবীর: আমার বাসার সামনে আনন্দময়ী কালীমন্দির। এখানে দুপুর ১২টায় অন্তত ১০০ জন লোক এসে হামলার চেষ্টা চালান। আমরা এলাকার লোকজন এসে তাঁদের প্রতিহত করি। এরপর আমরা পুলিশকে বিষয়টি জানাই। পুলিশ যথাসময়ে এখানে আসেনি। এর ৪৫ মিনিট পরে আবার তাঁরা আসেন। তাঁদের হাতে ছিল ইটপাটকেল, লাঠি ও মরিচের গুঁড়া। তখনো তাদের প্রতিহত করা হয়। পরে তাঁরা মনোহরপুর রাজরাজেশ্বরী কালীমন্দিরে হামলার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া তাঁরা কাপড়িয়াপট্টির চাঁনমনী কালীমন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও প্রতিমা ভাঙচুর করেন। পরে ঠাকুরপাড়া রক্ষাময়ী কালীমন্দিরে হামলা চালান। সেখানে তো পুলিশের সামনে উত্তেজিত তরুণদের সঙ্গে হিন্দু তরুণদের ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। প্রশাসনকেই এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে হবে। এ ঘটনার বিচার না হলে হিন্দুদের মনে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তা কোনো দিন মুছবে না। আমরা তো আমাদের পাড়ায় হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে বসবাস করছি। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে তৎকালীন কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান অতীন্দ্র মোহন রায় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেন। তখনো তো আমরা অসাম্প্রদায়িক কুমিল্লায় ছিলাম।
প্রথম আলো: অতীতে কুমিল্লায় এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে কি?
আহসানুল কবীর: ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে ঘিরে স্যার সলিমুল্লাহ কুমিল্লায় আসেন। তাঁর আগমন ঠেকাতে একবার বিক্ষোভ হয়। তবে সেটি বড় আকারে হয়নি। ১৯৬৪ সালে সোনারগাঁয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। তখন কুমিল্লাবাসীকে শান্ত রাখার জন্য পাড়ায় পাড়ায় কমিটি করা হয়। পাহারা বসানো হয়। তৎকালীন কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (এ জেড ওবায়দুল্লাহ), মুসলিম লীগের নেতা আবাদ মিয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা জহিরুল কাইয়ুম মিলে কুমিল্লাকে রক্ষা করেন। শান্তিতে রাখেন। এখন আদর্শের রাজনৈতিক চর্চা না থাকার কারণে এমনটা হয়েছে। এটা কুমিল্লার বিষয় নয়, এটা পুরো দেশের বিষয়।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ ।
আহসানুল কবীর: প্রথম আলোর পাঠকদেরও ধন্যবাদ।