পুকুর দখল হচ্ছে দুভাবে। একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রভাব খাটিয়ে, অন্য কৌশল হচ্ছে লিজের নাম করে দখল।
জায়গাটির নামকরণ একটি পুকুরের নামে। জেলা প্রশাসনের নথিতেও আছে ‘হিমারদিঘি’ নামের পুকুরটির তথ্য। তবে গত মঙ্গলবার টঙ্গীর হিমারদিঘি এলাকায় গিয়ে পুকুরটির অস্তিত্ব দেখা গেল না। পুকুরটি কোথায় ছিল, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্যও দিতে পারছিলেন না স্থানীয় লোকজন। পরে নথি দেখে পুকুরের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়। দেখা গেল, পাঁচ বিঘা আয়তনের সরকারি পুকুরটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে বাড়িঘরসহ স্থায়ী–অস্থায়ী অবকাঠামো।
গাজীপুর জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, জেলায় সরকারি বা খাসপুকুরের সংখ্যা ৮৮৭টি। তবে এর মধ্যে হিমারদিঘির মতো ১৯২টি পুকুর পুরোপুরি বা আংশিক ভরাট করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ২২ শতাংশ পুকুর বেহাত হয়ে গেছে। বেদখলে থাকা পুকুরের মোট আয়তন প্রায় ১৫১ একর। ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মী ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব পুকুরের বেশির ভাগই ভরাট করে স্থায়ী–অস্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তুলেছেন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুর জেলার ৮৮৭টি পুকুরের মধ্যে মহানগর ও আশপাশের এলাকায় পুকুর থাকার কথা ৩৯০টি। তবে বাস্তবে আছে ২৩৬টি; অর্থাৎ ১৫৪টি পুকুর পুরোপুরি বা আংশিক ভরাট করা হয়েছে। এই হিসাবে মহানগর ও আশপাশের এলাকার ৩৯ শতাংশের বেশি পুকুর অবৈধ দখলদালদের কবলে চলে গেছে।
পুকুরগুলো আমরা ধরে রাখতে পারছি না। একদিকে পুকুর দখলমুক্ত করা হয়, অন্যদিকে আবার সেটি দখল হয়ে যাচ্ছে।আনিসুর রহমান, জেলা প্রশাসক, গাজীপুর
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুরে পুকুর দখল হচ্ছে মূলত দুভাবে। একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রভাব খাটিয়ে, অন্যটি হচ্ছে লিজের (সাময়িক বন্দোবস্ত) নামে দখল। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা রয়েছেন দখলদারদের তালিকায়। একাধিক কাউন্সিলর, এমনকি সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীও আছেন দখলদারদের মধ্যে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল নির্মাণের নামেও ভরাট করা হয়েছে বেশ কয়েকটি পুকুর।
এসব পুকুর রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুকুরগুলো আমরা ধরে রাখতে পারছি না। একদিকে পুকুর দখলমুক্ত করা হয়, অন্যদিকে আবার সেটি দখল হয়ে যাচ্ছে। যারা দুর্বৃত্ত, তারা প্রতিদিনই পুকুর দখল করতে যায়। সারাক্ষণ পুকুর পাহারা দেওয়ার মতো জনবল আমাদের নেই। পুকুর রক্ষণাবেক্ষণের বরাদ্দও খুব কম।’
টঙ্গীর হিমারদিঘি এলাকায় ‘হিমারদিঘি’ ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে চারটি পাকা বাড়ি। এ ছাড়া আছে টিনের ছাউনির ঘর ও ছাপরা। ভরাটের পর বাকি জায়গায় চলছে ঘর তৈরির কাজ। স্থানীয় লোকজন জানান, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে হিমারদিঘি দখল শুরু হয়। স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে উঠেছে গত এক দশকে। পুকুরটি দখলে জড়িত ৩০ জনের বেশি ব্যক্তি। তাঁদের একজন গাজীপুর মহানগর মোটর শ্রমিক লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁর বাড়ি সরকারি পুকুরের জায়গায় না। জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি।
আনোয়ার হোসেনের মতো দখলদারদের অনেকেরই দাবি, তাঁরা জমি কিনে বাড়ি করেছেন। এ জন্য তাঁরা উচ্চ আদালতে রিটও করেছেন।
সরকারি পুকুরগুলো জনগণের সম্পত্তি। এগুলো দ্রুততম সময়ে দখলমুক্ত করা প্রয়োজন।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)
‘হিমারদিঘি’র পূর্ব পাশের সীমানা–লাগোয়া বাড়িটি ফজলুল হক মৃধার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের সহায়তায় জাল নথি তৈরি করে স্থানীয় কয়েকজন পুকুরটির মালিকানা দাবি করে দখল শুরু করেন। জাল নথির মাধ্যমে এই জমি বিক্রিও করা হয়। তখন থেকেই হিমারদিঘি ভরাট শুরু হয়। গত ১০ বছরে পুকুরের জায়গায় গড়ে উঠেছে স্থায়ী অবকাঠামো। এরই মধ্যে সেখানে আটজন বাড়ি করেছেন। একটি গ্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে।
স্থানীয় ভূমি অফিস সূত্র জানায়, ২০১১ সালেও হিমারদিঘি পুকুরের কিছু অংশের অস্তিত্ব ছিল। সেটুকুও বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। ভূমি অফিস পুকুরটি দখলমুক্ত করতে জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে অনুরোধও করেছিল, কিন্তু দখলমুক্ত হয়নি।
টঙ্গী পৌর ভূমি অফিসের উপসহকারী কর্মকর্তা আরিফ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, হিমারদিঘি দখলমুক্ত করতে ২০১৬ সালে উচ্ছেদ মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু দখলদারেরা উচ্চ আদালতে রিট করলে উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এরপর হালনাগাদ কোনো তথ্য জানাতে পারেননি তিনি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন কার্যালয়ের পাশে একটি পুকুর গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুর রউফ ও তাঁর স্ত্রী তাসলিমার দখলে রয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে নিজেদের থাকার জন্য আধা পাকা বাড়ি রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব অংশে পাঁচ কক্ষের একটি আধা পাকা বাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আরও ১০ কক্ষের একটি আধা পাকা বাড়ি নির্মাণের কাজ চলছে। পুকুরের পশ্চিম অংশে রাস্তার পাশে একটি মার্কেট নির্মাণ করেছেন।
আবদুর রউফের স্ত্রী তাসলিমা দাবি করেন, তাঁরা যেখানে বাড়ি–মার্কেট নির্মাণ করেছেন, সেটি পুকুরের জায়গা নয়। এটি বসতবাড়ি হিসেবে ২০ বছর ধরে লিজ নিয়েছেন। তবে কত দিন পর্যন্ত লিজের মেয়াদ আছে, সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি তিনি।
গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৪০০ মিটার দূরে ‘টাঙ্কিরপাড়’ নামে একটি পুকুর রয়েছে। পুকুরটির দক্ষিণ পাশের বড় একটি অংশ এরই মধ্যে বেদখলে চলে গেছে। গাজীপুরের কালীগঞ্জের সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের পিয়ন আবদুল আওয়াল ও তাঁর ভাই খোরশেদ আলম সেখানে বাড়ি করেছেন।
আবদুল আউয়াল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, জেলা প্রশাসন থেকে লিজ নিয়ে তাঁরা বাড়ি করেছেন। তাঁর মতো আরও কয়েকজন লিজ নিয়ে পুকুরের এক অংশে বাড়ি ও মার্কেট নির্মাণ করেছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন কার্যালয়ের পাশের পুকুর ও টাঙ্কিরপাড় পুকুর দুটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কার্যালয়ের পাশের পুকুর দখলমুক্ত করতে প্রশাসনের বড় কর্মকর্তারা কিছু করতে পারেননি। সেখানে আমরা তো একেবারে নস্যি। পুকুর দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।’
টঙ্গীর আউচপাড়া মৌজায় মামদী মোল্লা স্কুল অ্যান্ড কলেজ লাগোয়া ছয় বিঘা আয়তনের পুকুরটির দুই–তৃতীয়াংশ এরই মধ্যে ভরাট করা হয়েছে। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একটি টিনের ছাউনি তৈরি করা হয়েছে। একই ওয়ার্ডের খাঁপাড়া সড়কের পাশে ছয় বিঘা আয়তনের পুকুরটির পশ্চিম অংশ ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে বাড়ি ও কবরস্থান। বাকি অংশটি ভরাটের জন্য ময়লা–আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। পুকুরটির একটি অংশে পানির পাম্প বসিয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন।
এ দুটি পুকুর পড়েছে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাসির উদ্দিন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, কলেজের পাশের পুকুরটি স্থানীয় ভূমিহীন মানুষ ভরাট করে ঘর নির্মাণ করে থাকছেন। আর কলেজের টিনের ছাউনি করা হয়েছে অস্থায়ী ভিত্তিতে। ভরাট করা বাকি অংশ মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর খাঁপাড়ার পুকুরে জনস্বার্থে হাঁটার জন্য একটি রাস্তা নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ জন্য জেলা প্রশাসনের অনুমতি চাওয়া হবে।
টঙ্গীর শিলমুনে পাঁচ বিঘা আয়তনের একটি পুকুর ভরাট করে সেখানে শিলমুন আবদুল হাকিম উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা ও দোতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। একটি টিনশেডও রয়েছে সেখানে। চারদিকে দেয়াল করা হয়েছে। এলাকাটি পড়েছে ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাদেক আলীর দাবি, পুকুর ভরাট করা হয়েছে জনস্বার্থে। স্কুল নির্মাণের বিষয়টি জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি—সবাই জানেন।
অন্য অনেক শহরের মতো গাজীপুরেও দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেক জলাশয় ভরাট করেও তৈরি হচ্ছে কারখানা। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) গত ফেব্রুয়ারিতে এক সমীক্ষায় জানায়, তখন দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ ছিল গাজীপুরে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও গবেষক দলের প্রধান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো এলাকায় পুকুর বেশি থাকলে, আর্দ্রতা বেশি থাকবে। আর্দ্রতা বেশি থাকলে ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর পুকুর ভরাট হলে বায়ুদূষণের মাত্রা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। দেশে অধিকাংশ পুকুর ভরাট করা হয় আবর্জনা ফেলে। আবর্জনাগুলো পচে পুকুরের পানিদূষণের পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানিও দূষিত করে।
গাজীপুর জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, সবচেয়ে বেশি পুকুর বেহাত হয়েছে টঙ্গী ও গাছা এলাকায়। তবে পুকুরগুলো দখলমুক্ত করতে কার্যকর কোনো উদ্যোগের কথা জানাতে পারেননি তাঁরা। অবশ্য ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়া ১৯২টি পুকুর খননের জন্য একটি তালিকা তৈরি করেছে জেলা প্রশাসন। গত বছরের নভেম্বরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে তালিকাটি পাঠিয়ে খননের জন্য একটি প্রকল্প নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি পুকুরগুলো জনগণের সম্পত্তি। এগুলো দ্রুততম সময়ে দখলমুক্ত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, পুকুরগুলো চিহ্নিত করে দখলমুক্ত করে সাইনবোর্ড দেওয়া উচিত। পাশাপাশি পুকুরগুলো সঠিক প্রক্রিয়ায় রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। যেসব পুকুর ব্যক্তি দখলে চলে গেছে, সেগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
(প্রতিবেদন তৈরি করতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর গাজীপুর সংবাদদাতা আল-আমিন)