১৬ হাসপাতালে ২৮টি যন্ত্র বাক্সবন্দী

রোগনির্ণয় যন্ত্র অব্যবহৃত থাকার প্রধান কারণ সংশ্লিষ্ট লোকবলের অভাব। কোথাও কারিগরি সহায়তার অভাবে যন্ত্র বসানো যাচ্ছে না।

ফরিদপুর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে বাক্সবন্দী অবস্থায় এক্স–রে মেশিন পড়ে আছে। ১৮ আগস্ট ফরিদপুর সদরের ভাজনডাঙ্গায়
  ছবি: আলীমুজ্জামান

দেশের ১৬টি সরকারি হাসপাতালে ২৮টি রোগনির্ণয় যন্ত্র বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি ও ভেন্টিলেটর যন্ত্র। পড়ে থেকে কোনো যন্ত্র নষ্টও হয়ে গেছে। কোনোটি নষ্ট হওয়ার উপক্রম।

বেশির ভাগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই জানিয়েছে, যন্ত্র অব্যবহৃত থাকার প্রধান কারণ সংশ্লিষ্ট লোকবলের অভাব। কোথাও কারিগরি সহায়তার অভাবে যন্ত্র বসানো যায়নি।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, বাক্সবন্দী যন্ত্রগুলোর মধ্যে আছে ১৩টি এক্স-রে, ছয়টি ভেন্টিলেটর, চারটি আলট্রাসনোগ্রাম, একটি ইসিজি, একটি ল্যাপারোস্কপি, একটি কালচার ইনকিউবেটর, একটি হট এয়ার ওভেন ও একটি অটোক্লেভ মেশিন। ১৬ আগস্ট পর্যন্ত যন্ত্রগুলো এই অবস্থায় ছিল।

করোনার এই সময়ে এক্স-রে, ইসিজি, ভেন্টিলেটর এবং আইসিইউ সরঞ্জাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের ফুসফুসে সংক্রমণ শনাক্তের জন্য প্রাথমিকভাবে এক্স-রে করা জরুরি। আইসিইউ সহায়তা এবং ভেন্টিলেটর এ সময়ে জীবন রক্ষায় অপর নাম। যন্ত্রগুলো বাক্সবন্দী থাকায় স্বাভাবিকভাবে যথাযথ সেবা পাননি স্থানীয় লোকজন।

বগুড়ার ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি করে এক্স-রে, ইসিজি ও আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র কারিগরি সহায়তার অভাবে স্থাপন করা যায়নি। ১৭ বছরেও যন্ত্রগুলো বাক্স থেকে বের করা হয়নি।

ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাসানুল হাছিব বলেন, এক্স-রে যন্ত্রটি প্রথম থেকেই নষ্ট ছিল। ইসিজি ও আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র দুটি পড়ে থাকায় নষ্ট হয়ে থাকতে পারে। এ কারণে ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্রের জন্য কয়েক দফা প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

আরও ১২ এক্স-রে যন্ত্র

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, রামগঞ্জ ও কমলনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চারটি, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুটি, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সুনামগঞ্জের ধরমপাশা ও জগন্নাথপুর, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, জামালপুরের সরিষাবাড়ী ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি করে এক্স-রে যন্ত্র বাক্সবন্দী অবস্থায় আছে।

বগুড়া, ফরিদপুর, নড়াইল জেলায় গত জুন থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু অনেক বেশি ছিল। পটুয়াখালী ও সুনামগঞ্জের হাসপাতালে একই সময়ে রোগীর চাপ ছিল বেশি। ফরিদপুরের সিভিল সার্জন মো. ছিদ্দীকুর রহমান বলেন, ফরিদপুরে করোনার সংক্রমণ ৫৫ ভাগে উঠেছিল। এখন ২৮ থেকে ৩৪–এর মধ্যে ওঠানামা করছে।

ফরিদপুর শহরের লক্ষ্মীপুর মহল্লার বাসিন্দা লাল মিয়া (৫৯) বলেন, ‘করোনার কারণে আমার শ্বাসকষ্ট হয়। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়েছেন এক্স-রে করানোর। কিন্তু ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে এক্স–রে করাতে পারিনি। পরে বেশি টাকা দিয়ে ক্লিনিকে গিয়ে এক্স-রে করাই।’

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা রেজাউল করিম জানান, তিনি নারকেলগাছ থেকে পড়ে গেছেন। চিকিৎসক তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পায়ের ও হাতের এক্স-রে করাতে বলেন। হাসপাতালে এক্স-রে যন্ত্র চালু না থাকায় ৭০-৮০ টাকার এক্স-রে পৌর শহরের একটি ক্লিনিক থেকে ৪০০ টাকায় করিয়েছেন।

ধরমপাশা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. এমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে এক্স-রে টেকনোলজিস্ট, সনোলজিস্টসহ প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় নতুন এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এই হাসপাতালের যাবতীয় সমস্যার বিষয়ে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

বগুড়ার ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া ঘরবন্দী এক্স-রেসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি। সোমবার দুপুরে তোলা

ভেন্টিলেটর

চার মাসের বেশি সময় ধরে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারটি ভেন্টিলেটর এখনো বাক্সে পড়ে আছে। এগুলোর মধ্যে দুটি এসেছে চীনের জ্যাক মা ফাউন্ডেশন থেকে।

পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, এখানে যে ভেন্টিলেটর পাঠানো হয়েছে, তা চালু করা সম্ভব নয়। কারণ, এটা চালু করার মতো সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই।

ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে দুটি ভেন্টিলেটর বাক্সে পড়ে আছে। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) গণেশ কুমার আগরওয়ালা বলেন, ‘দুটি ভেন্টিলেটর এসেছে প্রায় চার মাস আগে। এগুলো জ্যাক মা ফাউন্ডেশন থেকে আসা। এক মাস আগে বাক্স দুটি আমরা খুলে দেখি, ওগুলো পূর্ণাঙ্গ ভেন্টিলেটর নয়, ভেন্টিলেটরের অংশমাত্র। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।’

অন্যান্য যন্ত্রপাতি

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, সুনামগঞ্জের ধরমপাশা ও জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি করে মোট তিনটি আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে। এগুলোর মধ্যে গোয়ালন্দে আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রটি সাত বছর ধরে বাক্সবন্দী।

গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আসিফ মাহমুদ বলেন, জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো লোকজন এসে আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রটি দেখে গেছেন। তাঁরা বলছেন, যন্ত্রটির সফটওয়্যারসহ অন্যান্য জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। কাজেই এটি এখন অচল।

নড়াইল সদর হাসপাতালের ল্যাপারোস্কপি যন্ত্রটি দুই বছর ধরে পড়ে আছে বাক্সের ভেতর।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ‘আগার’ নামের রাসায়নিকের সরবরাহ না থাকায় একটি কালচার ইনকিউবেটর এবং একটি হট এয়ার ওভেন ১৫ বছর ধরে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এখনো বাক্স খোলা হয়নি। এ রাসায়নিক ঢাকায় অবস্থিত স্বাস্থ্য বিভাগের কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগার থেকে সরবরাহ করা হয়।

কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, রোগীদের মলমূত্র ও রক্ত সংগ্রহ করে তা বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপকরণের সংমিশ্রণে টানা ৭২ ঘণ্টা ‘কালচার ইনকিউবেটর’ যন্ত্রে রাখা হয়। ওই যন্ত্র ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করে। এরপর ‘হট এয়ার ওভেনে’ নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করা হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ‘আগার’ নামক রাসায়নিক উপকরণ সরবরাহ করে না। ফলে কালচার ইনকিউবেটর কাজে লাগানো যাচ্ছে না। হট এয়ার ওভেনও ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। বিষয়টি অনেক আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

অভিযোগ আছে, ব্যবসায়ীরা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে যন্ত্র কিনে তা হাসপাতালে পৌঁছে দেয়, হাসপাতালের চাহিদার বিষয় বিবেচনা করা হয় না। আবার সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রয়োজনের কথা না ভেবেই কোনো কোনো হাসপাতাল যন্ত্র কিনে ফেলে। যন্ত্র চালানোর মতো প্রশিক্ষিত জনবল না থাকলেও অনেক সময় যন্ত্র কেনা হয়, সেসব যন্ত্র বেকার পড়ে থাকে। এভাবে বছরের পর বছর চলছে। জবাবদিহির ঘাটতি ও সমন্বয়ের অভাবে এসব ঘটে চলেছে।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যন্ত্রপাতি কেনাকাটা ও ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ অধিকতর দায়িত্বশীল হলে এমন ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, তার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

[সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা থেকে প্রতিবেদনের তথ্য পাঠিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]