ঢাকা ওয়াসার সেবায় গ্রাহকদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি অসন্তুষ্ট—গত বছরের এপ্রিলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উল্লেখ করেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। নতুন খবর হচ্ছে, আগামী এপ্রিল মাস থেকে গ্রাহকদের আগের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে ওয়াসার পানি কিনতে হবে। তবে সেই পানি ‘সুপেয়’ হবে কি না, তার নিশ্চয়তা অবশ্য নেই।
আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর থেকে গত প্রায় ১২ বছরে মোট ১৩ বার পানির দাম বেড়েছে। একই সময়ে পানির দাম প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে ঢাকায় আবাসিক গ্রাহকদের জন্য পানির দাম ছিল প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। দাম বাড়ানোর কারণে আগামী এপ্রিল থেকে তা হচ্ছে ২০ টাকা।
টিআইবি গবেষণায় উল্লেখ করেছিল, ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করে। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সেদ্ধ করে পান করে। অন্যদিকে সাধারণ নাগরিকেরা বিভিন্ন সময়ে ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ, ময়লা থাকার অভিযোগ করে আসছে। ওয়াসার পানির মান কেমন এবং তা পানের উপযোগী কি না, তা দেখাতে গত বছরের ২৩ এপ্রিলে কারওয়ান বাজারে ওয়াসা ভবনের সামনে পরিবার নিয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন জুরাইন নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান। তাঁর ইচ্ছা ছিল ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানকে ওয়াসার পানি দিয়ে বানানো এক গ্লাস শরবত খাওয়ানোর। সেদিন তাঁর আহ্বানে সাড়া দেননি এমডি।
এখন নতুন করে ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর খবর শোনার পর মিজানুর রহমান গতকাল শুক্রবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, জুরাইন, দনিয়া, শ্যামপুর, কদমতলী, গেন্ডারিয়া, যাত্রাবাড়ীসহ আশপাশের এলাকার মানুষ ওয়াসার পানি ব্যবহার করে পান করার সাহস করে না। আপাতদৃষ্টিতে পানি ভালো দেখালেও তা পানের যোগ্য নয়। এরপরও পানির দাম বাড়ানো চরম অপরাধ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
>আগামী এপ্রিল মাস থেকে গ্রাহকদের আগের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে ওয়াসার পানি কিনতে হবে
ওয়াসার আইন অনুযায়ী, ওয়াসার বোর্ড প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারে। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে এবার পানির দাম ২৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত বছরের জুলাই মাসে পানির দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন ইউনিটপ্রতি ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছিল।
বিভিন্ন প্রকল্পে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের জন্য পানির দাম বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে ছিল না বলে ওয়াসার কর্মকর্তারা দাবি করেছেন। ওয়াসা সূত্র জানায়, এবার পানির দাম ৮০ শতাংশ বাড়াতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে মন্ত্রণালয় আবাসিক গ্রাহক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর বিষয়ে মত দেয়। প্রতি ইউনিট পানির দাম ১১ টাকা ৫৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা অনুমোদন করেছে মন্ত্রণালয়। আর বাণিজ্যিক খাতে ৩৭ টাকা ৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করা হয়েছে। এতে গড়ে ৮ শতাংশ দাম বেড়েছে।
ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, গত আট মাসের মধ্যে দুই দফা পানির দাম বাড়াল ঢাকা ওয়াসা। এর আগে গত জুলাইয়েও ৫ শতাংশ হারে দাম বাড়ানো হয়েছিল। ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর পানির দাম একবার করে বেড়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে দাম বেড়েছিল দুবার।
গ্রাহক পর্যায়ে অস্বাভাবিক হারে পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে যে হারে দাম বাড়ানো হয়েছে, তা উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম। এমনকি এশিয়ার বিভিন্ন বড় শহরের তুলনায় সবচেয়ে কম দামে ঢাকা ওয়াসা পানি বিক্রি করছে বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর মতে, দাম না বাড়িয়ে বিকল্প কিছু ছিল না ওয়াসার।
পানির দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে ওয়াসা জানিয়েছে, উৎপাদন ও বিতরণ ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের সামঞ্জস্য করা। আরেকটি কারণ দেখানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোয় তার সঙ্গে ব্যয় সমন্বয় করা। ওয়াসার দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণের সুদ এবং আসলের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
তবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সেবার মান উন্নত ও পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত না করে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ঢাকা ওয়াসার একগুঁয়েমি ও স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেন, পরিচালন ব্যয়, ঘাটতি ও ঋণ পরিশোধের অজুহাতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে পানির দাম বাড়ানো অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।
বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার তিনটি পানি শোধনাগার এবং ৯৩০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। তবে গভীর নলকূপ চালু রয়েছে ৮৭০টি। বর্তমানে ওয়াসার পানি উৎপাদনক্ষমতা ২৬০ কোটি লিটার। আর চাহিদা রয়েছে ২৩৫ কোটি থেকে ২৪০ কোটি লিটার। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও রাজধানীর ৩ লাখ ৭৫ হাজার গ্রাহকের মধ্যে বেশির ভাগই পানির মান নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। কারণ, দাম বাড়লেও সে তুলনায় পানির মান ভালো হচ্ছে না।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, একদিকে ভালো মানের পানি দেওয়া হচ্ছে না, অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসায় অনিয়ম–দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা দিন দিন বাড়ছে। এগুলো দূর করলে অস্বাভাবিক হারে পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না।