১০ বছরে ৯৩৩ কোটি টাকার সম্পদ

নামে-বেনামে দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি, ফ্ল্যাট ও হোটেল কিনেছেন পি কে হালদার। আদালতে দুদকের অভিযোগপত্র।

  • কানাডায় পাচার করেছেন প্রায় ৮০ কোটি টাকা।

  • বৈধ আয়ের পরিমাণ মাত্র ১২ কোটি টাকা।

  • নিকটাত্মীয়দের নামেও প্রচুর জমি কিনেছেন।

প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার

গ্লোবাল ইসলামী (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার নামে-বেনামে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৯৩৩ কোটি টাকার জমি, ফ্ল্যাট ও হোটেল কিনেছেন। এ ছাড়া তিনি কানাডায় পাচার করেছেন প্রায় ৮০ কোটি টাকা। আদালতে জমা দেওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযোগপত্রে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

দুদক বলেছে, পিরোজপুরের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার মাত্র ১০ বছরের (২০০৯-১৯ সাল) ব্যবধানে এত সম্পদ গড়েছেন। তাঁর বৈধ আয়ের পরিমাণ মাত্র ১২ কোটি টাকা।

দেশের চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদার নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানির নামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নেন। এই টাকা আর ফেরত না আসায় ওই চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। প্রতিষ্ঠান চারটি হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। টাকা বের করার আগে শেয়ার কিনে তিনি এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। এই আর্থিক কেলেঙ্কারি জানাজানি হয় ২০২০ সালের শুরুতে। আর তিনি দেশ ছাড়েন ২০১৯ সালের শেষ দিকে।

পলাতক থাকা অবস্থায় ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করে দুদক। এই মামলাতেই পি কে হালদার, তাঁর মা, ভাই, নিকটাত্মীয়সহ ১৪ জনের নামে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে দুদক। ২০ ফেব্রুয়ারি তা আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হবে। এই মামলায় পি কে হালদারের মামাতো ভাই শঙ্খ ব্যাপারী, ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুকুমার মৃধা, অনিন্দিতা মৃধা ও অবন্তিকা বড়াল গ্রেপ্তার হন। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পি কে হালদার, তাঁর মা, ভাইসহ ১০ জন পলাতক রয়েছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন গতকাল মঙ্গলবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পি কে হালদার নামে-বেনামে যে সম্পদ করেছেন, তা আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে তুলে ধরা হয়েছে। ওই সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য ৯৩৩ কোটি টাকার কম হবে না।

৯৩৩ কোটি টাকার জমি ও ফ্ল্যাট

দুদকের অভিযোগপত্রে তথ্য বলছে, পি কে হালদার নামে-বেনামে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬ হাজার ৭৯০ শতাংশ জমি কিনেছেন। এই সম্পদের বাজারমূল্য দেখানো হয়েছে ৩৯১ কোটি ৭৫ লাখ ৮১ হাজার ১২ টাকা। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী এই সম্পদের মূল্য ৯৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিজের নামে তিনি জমি কিনেছেন ৪ হাজার ১৭৪ শতাংশ। এর দাম দলিলে দেখানো হয়েছে ৬৭ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ৯৩০ টাকা। অথচ এই সম্পদের বর্তমান মূল্য ২২৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া ধানমন্ডিতে পি কের নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রশান্ত তাঁর নিকটাত্মীয় পূর্ণিমা রানী হালদারের নামে উত্তরায় একটি ভবন করেছেন। যার দাম ১২ কোটি টাকা। আর পূর্ণিমার ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রির নামে তেজগাঁও, তেজতুরী বাজার ও গ্রিন রোডে ১০৯ শতাংশ জমি কেনেন। যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকা। প্রশান্ত তাঁর কাগুজে কোম্পানি ক্লিউইস্টোন ফুডসের নামে কক্সবাজারে ২ একর জমির ওপর আটতলা হোটেল (র‌্যাডিসন নামে পরিচিত) তৈরি করেছেন। যার আর্থিক মূল্য এখন ২৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া পি কের খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী এবং অনঙ্গ মোহন রায়ের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৪০৪ শতাংশ জমি কিনেছেন, এর দাম ১৬৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও কানাডীয় ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্যের বরাত দিয়ে দুদক প্রতিবেদনে বলেছে, পি কে হালদার ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তাঁর ভাই প্রীতিশ হালদারের কাছে ১ কোটি ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৬৪ কানাডীয় ডলার পাচার করেন। বাংলাদেশি টাকায় তা দাঁড়ায় প্রায় ৮০ কোটি টাকা।

একা পি কে হালদারের পক্ষে এত কম সময়ে এত সম্পদের মালিক হওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের যোগসাজশে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে পি কে হালদার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কেও দুদককে খোঁজ করতে হবে। তাঁদেরও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।