১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার ৫১৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় আজ মঙ্গলবার দুপুরে প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী ওমর ফুয়াদ প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে চোরাচালান মামলার রায় ২৬০ পৃষ্ঠা এবং অস্ত্র আটক মামলার রায় ২৫৪ পৃষ্ঠা।
গত ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
দুটি মামলার মধ্যে একটিতে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
চোরাচালানের মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৫২ আসামির মধ্যে ১৪ জনকে এই সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা এই মামলায় একই সঙ্গে এঁদের পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়। আর অস্ত্র আইনে করা মামলায় এই ১৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এই মামলায় আসামি ছিলেন ৫০ জন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল সিইউএফএল ঘাট থেকে আটক করা হয় ১০ ট্রাকভর্তি অস্ত্রের চালান। এ নিয়ে কর্ণফুলী থানায় ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন ও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগ এনে দুটি মামলা হয়। সিআইডি পুলিশ দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে। এর বিচারও একসঙ্গে শুরু হয়।
আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মামলা। এ মামলায় রাষ্ট্রের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এমনকি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (এনএসআই) কর্মকর্তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা বিশ্বের আর কোথাও ঘটেছে কি না সন্দেহ।
বাবর, নিজামী ও পরেশ বড়ুয়া ছাড়া ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রহিম, পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, এনএসআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব নুরুল আমিন, অস্ত্র বহনকারী ট্রলারের মালিক হাজি সোবহান, চোরাকারবারি হাফিজুর রহমান এবং অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দ্বীন মোহাম্মদ। এঁদের মধ্যে পরেশ বড়ুয়া ও নুরুল আমিন পলাতক।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের কথা শুনেও নীরব ছিলেন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক সাদিক হাসান রুমী তাঁকে অস্ত্র আটকের তথ্য জানিয়েছিলেন।
বিচারক বলেন, এ অস্ত্র ও চোরাচালানের মামলা দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এখানে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (এনএসআই) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন। এসব কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় তাঁদের জবানবন্দিতে এবং যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁরা একে অন্যকে জড়িয়ে যেসব তথ্য দিয়েছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে তাঁদের সঙ্গে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) যোগাযোগ ছিল। তাঁরা এটা স্বীকারও করেছেন। এনএসআইয়ের তখনকার মহাপরিচালক (ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম) তাঁদের সহায়তায় সস্ত্রীক দুবাইয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন বলে স্বীকার করেছেন।
এনএসআইয়ের উপপরিচালক মেজর লিয়াকত স্বীকার করেন, উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া ও অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। তিনি এ বিষয়ে জবানবন্দিও দিয়েছিলেন। অস্ত্র আটকের সময় মেজর লিয়াকত নিজেকে আবুল হোসেন পরিচয় দিয়ে বাধা দিয়েছিলেন বলে স্বীকার করেছিলেন।
রায়ে বলা হয়, ডিজিএফআইয়ের তত্কালীন মহাপরিচালক সাদিক হাসান রুমী সাক্ষ্য দেওয়ার সময় জানিয়েছিলেন, তিনি তখনকার প্রধানমন্ত্রীকে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নীরবতা দেখিয়েছিলেন। এ ঘটনাও মামলায় এসেছে।
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরের কথা উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এ ঘটনা নিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। কমিটিতে পাঁচজন সদস্য ছিলেন, যাঁদের তিনজনই এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামানও সাক্ষ্য দিয়েছেন।
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ওই সময় শিল্পমন্ত্রী ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। শিল্পসচিব ছিলেন শোয়েব আহমেদ। তিনি সাক্ষ্য দিতে এসে বলেছিলেন, বিসিআইসি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। তাই সিএফইউএল বিসিআইসির অধীন হওয়ার কারণে এর দায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের। ওই সময় বিসিআইসির চেয়ারম্যান ছিলেন ইমামুজ্জামান। শোয়েব আহমেদ তাঁর সাক্ষ্যে বলেছিলেন, অস্ত্র আটকের ঘটনা তিনি নিজামীকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো পদক্ষেপ না নিতে বলেছিলেন। এ ঘটনা সরকারের সবাই অবহিত আছেন বলেও তিনি (নিজামী) তাঁকে জানিয়েছিলেন।
পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর ঘটনার পর চট্টগ্রামে এসে অস্ত্র পরিদর্শন করেছেন, বৈঠক করেছেন, তদন্ত কমিটি করেছেন। এসব বিষয় এ মামলায় এসেছে। রায়ে বলা হয়, লুত্ফুজ্জামান বাবর ও মতিউর রহমান নিজামী আদালতে বারবার বলেছিলেন, তাঁদের রাজনৈতিক কারণে হয়রানি করার জন্য এ মামলায় জড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে তাঁদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে দেখা যায়নি। যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁরা তাঁদের অধীন ছিলেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, সাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে এ মামলায় হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিমের জন্য উইং কমান্ডার (অব.) সাহাবউদ্দিনের মাধ্যমে টাকা দেয় দুবাইয়ের এআরওয়াই গ্রুপ। এ গ্রুপের আবদুর রাজ্জাক ইউসুফের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের যোগাযোগ ছিল।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, অস্ত্র আটক ও চোরাচালান মামলায় ২০০৪ সালের ১১ জুন প্রথম দফা ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২৫ আগস্ট সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ মামলা দুটির অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৬ জুন নতুন করে বাবর, নিজামীসহ ১১ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। অস্ত্র আটক মামলায় ৫০ জন এবং চোরাচালান আইনে ৫২ জনকে আসামি করা হয়। ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। অস্ত্র আটক মামলায় ৫৬ এবং চোরাচালান আইনে ৫৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।