প্রবাসী কর্মীদের সন্তানদের জন্য এসব স্কুল করার কথা বলছে মন্ত্রণালয়।
মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের চার দেশে প্রবাসী কর্মীদের সন্তানদের জন্য পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ জন্য ব্যয় হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যেসব বাংলাদেশি কর্মী আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই শ্রমিক। তাঁদের ছেলেমেয়েরা দেশেই থাকেন। ফলে এসব স্কুল স্থাপনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
সৌদি আরবের রিয়াদ ও দাম্মামে দুটি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও গ্রিসের এথেন্সে একটি করে মোট পাঁচটি স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এসব স্কুল স্থাপন করা হচ্ছে। সম্প্রতি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব তথ্য তুলে ধরে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই নাম হবে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেনটেনিয়াল স্কুল’। ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট দেশের কোনো নেতার নাম যুক্ত করে যৌথ নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হতে পারে। এই পাঁচ স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ১০০ কোটি ২ লাখ ৬৭ হাজার ৫৫৮ টাকা ব্যয় বরাদ্দের বিষয়টিও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই বোর্ডের কল্যাণ তহবিল চলে প্রধানত প্রবাসী শ্রমিকদের দেওয়া টাকায়।
অভিবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সৌদি আরবে এখন ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ১০ লাখ, বাহরাইনে ২ লাখ এবং গ্রিসে ৩৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গ্রিসের স্কুলটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে করা হচ্ছে। অন্য চারটি স্কুল এখন সেখানে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশিরা পরিচালনা করেন। এসব স্কুলে (দশম শ্রেণি পর্যন্ত) শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা ও ইংরেজি।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গ্রিসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেনটেনিয়াল স্কুলের জন্য গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ২৬ কোটি ২৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫৫৮ টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত মে মাসে এক কোটি টাকা পাঠানো হয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাস-আল-খাইমাহ শহরে প্রবাসীদের উদ্যোগে বাংলাদেশ ইংলিশ প্রাইভেট স্কুল নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু আছে। এই স্কুলের জন্য ২০২০–২১ অর্থবছরে এক কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। দূতাবাসের ২০ কোটি টাকা চাহিদার বিপরীতে এ বছর আরও এক কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। স্কুলের নতুন ভবন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে করা হবে।
বাহরাইনে অবস্থিত বাংলাদেশ স্কুলের জন্য গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সভায় ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। অর্থ ছাড়ের বিষয়টি বোর্ডের আগামী বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।
সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য ১৭ কোটি ৯২ লাখ টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়েছে। রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস এই স্কুলের জন্য জমি নির্বাচন করেছে। অন্যদিকে সৌদি আরবের দাম্মামে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের (ইংরেজি মাধ্যম) জমি কেনা ও ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে ১৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকার ব্যয় প্রাক্কলন অনুমোদন দেওয়া হয়।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সভাপতি, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন প্রথম আলোকে বলেন, দাম্মামে এখনো তেমন কিছু হয়নি। অন্য স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। বাহরাইনে জমি কেনা হয়েছে, দুবাইয়ে স্কুলের নির্মাণ কাজ চলছে।
* সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও গ্রিসে হচ্ছে পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। * ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড স্কুল নির্মাণের ব্যয় বহন করবে। এই বোর্ডের কল্যাণ তহবিল চলে প্রধানত প্রবাসী শ্রমিকদের টাকায়।
এসব স্কুল থেকে প্রবাসী শ্রমিকেরা কতটুকু উপকার পাবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, প্রবাসী বলতে শুধু শ্রমিক বোঝায় না। শুধু শ্রমিকদের নয়, সব প্রবাসীর সামগ্রিক কল্যাণে তাঁরা নিয়োজিত। সবকিছু থেকে শ্রমিকেরা সরাসরি উপকৃত হতে হবেন, বিষয়টি এমন নয়। কিছু কাজ করা হয় প্রবাসীদের প্রমোট (উৎসাহ) করা ও সাপোর্ট (সহায়তা) দেওয়ার জন্য, যাতে তাঁরা দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হন।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৯৯০ সালে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিল গঠন করে সরকার। ২০১৮ সালে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থার রূপ নেয়। এই বোর্ডের একটি তহবিল আছে। কল্যাণ বোর্ডের তহবিলের টাকা আসে মূলত প্রবাসীদের কাছ থেকেই। তাঁরা বিদেশ যাওয়ার সময় সরকার নির্ধারিত ফি দিয়ে থাকেন, যেটা তহবিলে জমা হয়। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশন বা দূতাবাসও কল্যাণ ফি, সত্যায়ন ফি এবং কনস্যুলার ফির ওপর ১০ শতাংশ হারে (সারচার্জ) টাকা নেয়, যা এ তহবিলে জমা হয়। সরকারও তহবিলে অনুদান দেয়।
অভিবাসন খাত নিয়ে কাজ করা গবেষণা সংস্থা রামরুর নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা কল্যাণ তহবিলে চাঁদা দিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই স্বল্প দক্ষ শ্রমিক। অবস্থানগত কারণে তাঁরা পরিবার নিয়ে যেতে পারেন না। আর যাঁরা উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী, তাঁদের বেতন–ভাতা স্বাভাবিকভাবে বেশি হওয়ার কথা। তাঁরা সংশ্লিষ্ট দেশে সন্তানদের স্কুল–কলেজে পড়ানোর সংগতি রাখেন বলে ধরা যায়। আর কল্যাণ তহবিলে টাকা দিয়ে গ্রিসে যান, এমন সংখ্যা নগণ্য। তিনি বলেন, প্রবাসে বেতন–ভাতা, আইনি সহায়তাসহ শ্রমিকদের হাজারো সমস্যা আছে। সে সমস্যাগুলো আগে দেখা দরাকর। এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। তবে সরকার যদি মনে করে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দরকার, তাহলে সরকারের উন্নয়ন বাজেট থেকে এ বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে।