হোলি আর্টিজানে হামলার অভিযোগপত্র প্রস্তুত

>
• হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় জড়িত ২১ জন
• ১৩ জন পরে নিহত হন
• হাসনাত করিমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি
• গ্রেপ্তার আছেন ৬, পলাতক ৩

গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা মামলার অভিযোগপত্র প্রস্তুত। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সবুজ সংকেত পেলেই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেবে তদন্তকারী সংস্থা।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক হাসনাত করিমকে এই মামলার অভিযোগপত্রে আসামি করা হবে কি না, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে চলতি সপ্তাহেই অভিযোগপত্র আদালতে দেওয়া হতে পারে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হাসনাত করিম প্রশ্নে এখনো দ্বিধায় আছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বলেছে, দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের এই ঘটনার পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র-বোমা সংগ্রহ, সমন্বয়, আক্রমণসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত হিসেবে নব্য জেএমবির ২১ জনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। সেভাবে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। হাসনাত করিমকে অভিযোগপত্রভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হলে এই সংখ্যা হবে ২২।

জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৩ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন। নিহত এসব জঙ্গির অপরাধের বিবরণ অভিযোগপত্রে উল্লেখ থাকবে। তবে তাঁদের নাম আসামির কলামে থাকবে না। কারণ, প্রচলিত আইন অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তিদের নাম আসামির কলামে উল্লেখ করা হয় না।

হাসনাত করিম ছাড়া এই মামলায় গ্রেপ্তার আছেন আরও পাঁচজন। তাঁরা হলেন জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাশেদ ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ ওরফে নসরুল্লাহ, রকিবুল ইসলাম ওরফে রিগ্যান, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান। পুলিশ বলছে, এই পাঁচজনই নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সদস্য।

এঁদের মধ্যে রাজীব গান্ধী, রকিবুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাতে তাঁরাসহ মোট ২১ জনের নাম ঘুরেফিরে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে। যাঁদের মধ্যে তিনজন নব্য জেএমবির নেতা হাদিসুর রহমান ওরফে সাগর, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন পলাতক আছেন।

জানা গেছে, গত মাসে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এই ঘটনা যেহেতু খুবই স্পর্শকাতর, তাই অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার আগে সরকারের উচ্চপর্যায়ের মতামত নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে তদন্তকারী সংস্থা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চলতি মার্চে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। তিনি জানান, অভিযোগপত্রে হাসনাত করিমের নাম থাকবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।

হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাসহ এর আগের বেশ কয়েকটি ঘটনায় ইরাক-সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে। হোলি আর্টিজানে হামলা চলাকালে আইএসের নিজস্ব অনলাইনে হত্যাযজ্ঞের ছবি ও খবর প্রকাশ করা হয়। পরদিন হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী পাঁচ জঙ্গির ছবি প্রকাশ করে তাদের আইএসের যোদ্ধা দাবি করা হয়েছে। এমনকি সিরিয়ার রাকা থেকে বাংলাদেশি দুই জঙ্গি ভিডিও বার্তা আপলোড করে এই হামলাকারীদের অভিনন্দন জানিয়েছিল।

বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই আইএসের এই দাবি অস্বীকার করে আসছে। এখন তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বলছেন, তাঁরা এই হামলায় বিদেশি কোনো যোগাযোগ পাননি। তাঁরা বলছেন, হামলাকারীরা দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী, পুলিশ যাদের নাম দিয়েছে নব্য জেএমবি।

হামলার পর হোলি আর্টিজান বেকারি। প্রথম আলো ফাইল ছবি।

এর প্রধান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী। তিনি কানাডা থেকে বাংলাদেশে এসে পুরোনো জঙ্গিদের একটা অংশকে নিয়ে নব্য জেএমবি গঠন করেন।

কার, কী ভূমিকা
তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, তামিম চৌধুরী হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও সমন্বয়ক ছিলেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হচ্ছে। তামিমের সহসমন্বয়ক ছিলেন নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান।

জঙ্গিরা জিম্মিদের মুঠোফোনে হোলি আর্টিজানে হত্যাযজ্ঞের ছবি তুলে এবং রেস্তোরাঁর ওয়াই-ফাই ব্যবহার করে ওই সব ছবি পাঠায় মারজানের কাছে। তখন মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসায় মারজানের পাশে ছিলেন তামিম। তামিম ওই সব ছবি আইএসের কথিত বার্তা সংস্থা আমাক নিউজে পাঠান, যা ওই রাতে ইন্টারনেটে প্রচার পায়।

পরে সিআইডির ফরেনসিক পরীক্ষায় মুঠোফোন থেকে ওই সব ছবি উদ্ধার হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

হামলায় সরাসরি অংশ নেন ঢাকার রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, বগুড়ার শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। তাঁরা ২ জুলাই সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হন।

আক্রমণের জন্য এই পাঁচজনকে বাছাই করে পাঠান শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও রাজীব গান্ধী।

হামলাকারীদের প্রশিক্ষক ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম, রিগ্যান ও আবু রায়হান ওরফে তারেক। সফটওয়ার প্রকৌশলী বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট জঙ্গিদের আনুষঙ্গিক সহায়তার কাজ করেছেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে আসা ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেছিলেন। হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ জঙ্গিসহ জঙ্গিনেতাদের জন্য বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া করেন ব্যাংক কর্মকর্তা তানভীর কাদেরী।

ধর্মীয় প্রশিক্ষক ছিলেন নব্য জেএমবির শুরা সদস্য সারোয়ার জাহান। তিনি হামলার আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখে আসেন বলে তদন্তে এসেছে। ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহ এবং বোমা তৈরি ও সরবরাহে যুক্ত ছিলেন হাদিসুর রহমান ওরফে সাগর, সোহেল মাহফুজ, রাশেদ, বড় মিজান ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান। মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন হোলি আর্টিজানে হামলার প্রস্তুতি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

এই মামলার তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও জিম্মি হওয়া ব্যক্তি এবং নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরীর কিশোর ছেলে তাহরীম কাদেরীসহ ৩০ জন এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলায় মোট সাক্ষী ২০০ জনের মতো।

হত্যাযজ্ঞ-নৃশংসতা
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারি ও’কিচেন রেস্তোরাঁয় জঙ্গিরা অতর্কিতে হামলা চালায়। ওই রাতে সেখানে অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের বোমায় নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা রবিউল করিম ও সালাউদ্দিন খান। আহত হন র‍্যাব-১-এর তৎকালীন পরিচালক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ ও পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসানসহ পুলিশের ৩১ সদস্য। শ্বাসরুদ্ধকর এই হামলা ও জিম্মি পরিস্থিতির অবসান হয় পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে। অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ছাড়াও নিহত হন ওই রেস্তোরাঁর পাচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদার। পরে সেখান থেকে ১৮ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ, যাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করে জঙ্গিরা।

সেনা কমান্ডোদের অভিযানের আগে ও পরে ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাঁদের মধ্যে হাসনাত করিম ও তাঁর স্ত্রী, সন্তানও ছিলেন। হাসনাত করিমকে পরে এই ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা রেস্তোরাঁকর্মী জাকির হোসেন পরে হাসপাতালে মারা যান। পরে তদন্তে হোলি আর্টিজানের এই দুই কর্মীর সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা, তাদের নৃশংসতার ইতিহাস প্রায় দুই দশকের। কিন্তু হোলি আর্টিজানের হামলা জঙ্গিদের অতীতের সব হামলাকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে হামলার ধরন, জিম্মি সংকট তৈরি এবং এতসংখ্যক বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা এর আগে এ দেশে হয়নি।

তাই এই হামলার তদন্ত ও অভিযোগপত্র নিখুঁত করার চেষ্টা রয়েছে বলে জানান তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এমনকি রেওয়াজ না থাকলেও এই অভিযোগপত্র ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার চিন্তা করছেন তাঁরা। এ জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনুমোদন দরকার।

নিরাপত্তাসংক্রান্ত থিঙ্কট্যাংক প্রতিষ্ঠান বিআইপিএসএসের বাংলাদেশ সেন্টার ফর টেররিজম রিসার্চের পরিচালক শাফকাত মুনীর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আশা করছেন, যথাযথ তথ্য-উপাত্ত, আলামত-প্রমাণাদিসহ একটি ভালো অভিযোগপত্র আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হবে। তিনি বলেন, ‘জঙ্গিদের সামনে একটি নজির উপস্থাপন করতে হবে, তারা যে ভ্রান্ত আদর্শের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থা তৈরি করতে চায়, তার চেয়ে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা অনেক উৎকর্ষ।’