করোনার চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে যখন নানা কথা শোনা যাচ্ছে তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ শোনা গেল। পরপর দুই দিন জাতীয় সংসদে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। তাঁরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চান।
করোনা চিকিৎসায় যুক্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর হোটেলে থাকা–খাওয়া ও হোটেল থেকে হাসপাতালে যাওয়া–আসার জন্য ২০ কোটি টাকার মতো খরচ ধরা হয়েছে। ২০ কোটি টাকা নিয়ে কথা উঠছে কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মে–জুন মাসের বাজেট ২০ কোটি টাকা দিয়েছিলাম। অর্থ মন্ত্রণালয় সেই টাকা ছাড় করেছে। সেই টাকা নিয়ে কথা উঠছে।’
পরিচালক বলেছেন, ২০ কোটি টাকার মধ্যে হোটেলে থাকা, খাওয়া ও যাওয়া–আসার খরচ অন্তর্ভুক্ত।
তবে খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়েছে এমন তিনটি হোটেলের একটি বলেছে, তাদের পাওনা এক কিস্তি ইতিমধ্যে পরিশোধ হয়ে গেছে।
গত পরশু জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের প্রশ্ন তোলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুই মাসের খাবারের বিল ২০ কোটি টাকা হয় কী করে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই ব্যয়ের হিসাবটি অস্বাভাবিক মনে হয়। তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এত অস্বাভাবিক ব্যয় কেন হলো? এখানে কোনো অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকালও জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। গতকাল জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ঢাকা মেডিকেলের জন্য ৫০টি হোটেল ভাড়া নেওয়া হয়েছে। ৩ হাজার ৭০০ লোক এক মাস থেকেছেন। হিসাব করে বের করেছি ১ হাজার ১০০ টাকায় প্রতিটি কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়েছে। খাওয়ার বিল তিন বেলায় ৫০০ টাকা।
গত দুই দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এসব নিয়ে চিকিৎসকেরা বিব্রত। ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যাপক বলেছেন, ‘হাসপাতালে অনিয়ম হলেই চিকিৎসকদের দিকে আঙুল তোলা হয়। কিন্তু এসবের সঙ্গে চিকিৎসকেরা জড়িত না। তাঁরা চিকিৎসার কাজে জড়িত।’
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইনস্টিটিউট, মেডিসিন বিভাগ, কিডনি বিভাগের বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলের প্রাক্তন ছাত্র ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘এসব কাজে চিকিৎসকেরা কখনো জড়িত থাকে না, এই ক্ষেত্রেও জড়িত না। এসব ঘটনা, খবর চিকিৎসদের হতোদ্যম করে।’
রাজধানীর এয়ারপোর্ট রোডে একটি হোটেলে ঢাকা মেডিকেলের দুই শতাধিক চিকিৎসক অবস্থান করছেন। এই হোটেলে অবস্থান করছেন একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘হোটেল, থাকা–খাওয়া, যাওয়া–আসা এর কোনো কিছুর সঙ্গে চিকিৎসকদের কোনো সম্পর্ক নেই। যা কিছু করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যেন চিকিৎসকেরা অনিয়ম করেছেন। এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার।’
কোভিড হাসপাতালে দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক, নার্স বা অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য হোটেলে থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও পৃথক আবাসনের সুপারিশ করেছিল। দায়িত্ব পালনের সময় তাঁরা সংক্রমিত হতে পারেন এবং সেই সংক্রমণ পরিবারে ছড়াতে পারে, এই আশঙ্কায় তাঁদের পৃথক করে রাখা হয়। অনেক দেশেই এই ব্যবস্থা চালু আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, স্বাস্থ্যকর্মীরা সাত দিন কাজ করবেন। পরের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) থাকবেন। পরের সাত দিন পরিবারের সঙ্গে কাটাবেন। প্রতি সাত দিনে মোট জনবলের এক–চতুর্থাংশ হাসপাতালে কাজ করেন।
এর আগে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের হোটেলের খরচ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের ভিত্তিতে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তাকে গত মাসে বদলি করা হয়।
>করোনা চিকিৎসার দায়িত্ব থাকা চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়। খরচের প্রশ্ন ওঠায় অনেকেই বিব্রত।
ঢাকা মেডিকেলের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তদন্তের কথা বলেছেন। আমরাও তদন্ত চাই। কেউ যদি ঢাকা মেডিকেলের ব্যাপারে অপপ্রচার চালায় তারও তদন্ত হওয়া দরকার।’
জনবল কত
ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কোভিড চিকিৎসা আরম্ভ হয় মে মাসের শুরু থেকে। এই হাসপাতালে এখন ৮৫০টি শয্যায় কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল প্রথম আলোকে সারা দেশে কোভিড হাসপাতালের জনবলের হিসাব দিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসায় যুক্ত আছেন ১ হাজার ২১৮ জন স্বাস্থ্যকর্মী। এর মধ্যে চিকিৎসক ৪০৮ জন, নার্স ৫৮৮ জন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ৩২২ জন।
পরিচালকের হিসাব অনুযায়ী, মোট ৩ হাজার ৬৮৮ জন করোনা চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে চিকিৎসক ১ হাজার ২৫৮ জন, নার্স ১ হাজার ৫৬৭ জন, টেকনোলজিস্ট ৫০ জন, ফার্মাসিস্ট ১৬ জন, ৪৪৩ জন কর্মচারী এবং ৩৫৪ জন আনসার। তাঁরা ২১ দিন করে হোটেলে ছিলেন। সংসদে একই জনবলের হিসাব দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের একটি হোটেলে একজন তরুণ চিকিৎসক অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঢাকা মেডিকেলের তথ্যে বড় ফারাক। আমরা তো এসব জানি না। আমাদের জন্য কত বরাদ্দ তা–ও জানি না। কিন্তু অপবাদ থেকে দূরে থাকতে চাই। হোটেলে থেকে অনিয়মের অভিযোগ গায়ে মাখতে চাই না। আমি সত্যটা জানতে চাই।’
হাসপাতালের পরিচালক বলেছেন, কোনো অনিয়ম হয়নি। অনেকে হিসাব বুঝতে পারছে না বলেই অনিয়মের কথা বলছে। চিকিৎসকদের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন এতে বিভ্রান্ত বা মনঃক্ষুণ্ন না হন।
স্বাস্থ্যকর্মীরা কোথায় থাকেন
হাসপাতালের পরিচালক বলেন, শুরুর দিকে হোটেলের সংখ্যা কম ছিল। এখন ৩০টি হোটেলে চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা থাকছেন। যদিও সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ৫০টি হোটেলের কথা বলেছেন।
পরিচালক বলেন, পদমর্যাদা অনুযায়ী থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। দিনে পাঁচ হাজার টাকার ভাড়ার হোটেলও আছে, আবার ৬০০ টাকার হোটেলও আছে।
হাসপাতালের প্রশাসন সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হোটেল খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। পরে হাসপাতালের দুজন কর্মকর্তা করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের জন্য রাজধানীর আবাসিক হোটেল ভাড়া করেন। এর মধ্যে চারটি হোটেলে থাকেন চিকিৎসকেরা। বাকি ২৬টি আবাসিক হোটেলে থাকেন নার্স, টেকনিশিয়ান ও নিরাপত্তাকর্মীরা।
একাধিক চিকিৎসক ও নার্স খাবারের পরিমাণ ও মান নিয়ে প্রথম আলোর কাছে আপত্তি করেছেন। হোটেলে অবস্থানকারী একজন চিকিৎসক বলেছেন, ‘তিন বেলার খাবারের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৫০০ টাকা। আজকের দিনে এটা ভাবা যায়।’ হাসপাতালের পরিচালকও বলেছেন, প্রত্যেকের দৈনিক খাবারের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫০০ টাকা করে। এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঠিক করা।