হেফাজতে আস্থাশীল নেতৃত্ব চায় সরকার

হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সুসম্পর্ক ছিল। আস্থাশীল নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সংগঠনটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চায় সরকার।

হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ
হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ

একসময় যে হেফাজতে ইসলামকে খুশি রাখার জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল, সেই সংগঠনটিকে নিয়ন্ত্রণে আনাই এখন নীতিনির্ধারকদের অন্যতম লক্ষ্য। আস্থাশীল নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংগঠনটিকে আগের মতো বোঝাপড়ার মধ্যে নিতে চায় সরকার। এই লক্ষ্যে বর্তমান হেফাজতের নেতাদের গ্রেপ্তার, চাপ প্রয়োগ এবং ভেতরে-ভেতরে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চলছে।

সরকার ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এই চিন্তা ও তৎপরতার কথা জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, সরকার মনে করছে, হেফাজতে পছন্দমতো নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সংগঠনটি পরবর্তী সময়ে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এ জন্য সরকারের একটা পক্ষ প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীসহ তাঁর অনুসারীদের বা অপেক্ষাকৃত উদারপন্থীদের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে চাইছে। তবে সরকারের ভেতর আরেকটি পক্ষটি বলছে, আনাস মাদানী বা বাবুনগরী—কোনো পক্ষকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করা যাবে না। তাই কঠোর অবস্থান অব্যাহত রাখতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতের বিষয়ে সরকার আর কোনো দুর্বলতা দেখাবে না। তাদের সংঘাত-সহিংসতার যে প্রাপ্য, তা বুঝিয়ে দিতে হবে। কারণ, তারা সুযোগ পেলেই আঘাত করে।

২০০৯ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম প্রথম দৃশ্যমান হয়। তারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীদের সম-অধিকার দিয়ে প্রণীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতায় মাঠে নামে তখন। এক বছর পর তারা আবার রাস্তায় নামে জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে। তবে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরের অবস্থানকে কেন্দ্র করে। এরপর দীর্ঘ সময় হেফাজতকে সন্তুষ্ট রাখা বা সংগঠনটির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজ করে গেছে সরকার। হেফাজতের শীর্ষ নেতারাও সরকারের প্রতি আস্থা রাখার ঘোষণা দেন বিভিন্ন সময়।

সম্পর্কের পূর্বাপর

সরকার, আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোটকেন্দ্রিক বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে অভিযানের সময় হেফাজতের তৎকালীন আমির শাহ আহমদ শফী ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসায় আটকা পড়েন। সেখান থেকেই হেফাজতের নেতৃত্বের একটা অংশের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ তৈরি হয়। এরপর সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, প্রতিনিধিরা হেফাজত নেতাদের সঙ্গে হাটহাজারী মাদ্রাসায় বৈঠক করেন। অন্তত তিনজন মন্ত্রী, একজন মেয়র, জন পাঁচেক সাংসদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল হাটহাজারী মাদ্রাসায়।

২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরের লালদীঘি ময়দানে হেফাজত আয়োজিত দুই দিনব্যাপী শানে রিসালত সম্মেলনে সংগঠনের আমির শাহ আহমদ শফী বলেছিলেন, ‘হাসিনা সরকার, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ—সবাই আমাদের বন্ধু। এদের সঙ্গে কোনো আদাবত (শত্রুতা) নাই। কেউ যদি বলে, হাসিনা সরকার, ছাত্রলীগ আমাদের দুশমন, এটা বোঝাটা ভুল হবে।’

২০১৭ সালের শুরুতে হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে পাঠ্যবইয়ে ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজন করে সরকার। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই ছাপা হওয়ার পর জাতীয় পাঠ্যক্রম সমন্বয় কমিটির নজরে আসে যে হেফাজতের দাবি অনুসারে দুটি লেখা বাদ পড়েনি। তত দিনে প্রায় ১৫ লাখ বই ছাপা হয়ে যায়। পরে সেগুলোও বাতিল করে সরকার।

২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহ আহমদ শফীসহ কয়েক শ আলেমের উপস্থিতিতে গণভবনে এক অনুষ্ঠানে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের বছর ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে আইন পাস করে দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমান করা হয়।

একই বছর অক্টোবরে মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আহমদ শফী বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ বলেন, আমি আওয়ামী লীগ হয়ে গেছি। তারা কমবখত (নির্বোধ), তারা মিথ্যা কথা বলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এমনি মহব্বত করে কওমি সনদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমি আওয়ামী লীগ হই নাই।’

এরপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আল হাইআতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ ‘শোকরানা মাহফিলের’ আয়োজন করে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি ছিলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেওয়া হয়। এই মাহফিল নির্বিঘ্ন করতে পূর্বনির্ধারিত জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেয় সরকার।

এভাবে হেফাজতকে সন্তুষ্ট রাখার নীতি অবলম্বন করে যায় সরকার, যা অব্যাহত ছিল গত বছর শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর আগপর্যন্ত। হেফাজতও সরকারের প্রতি আস্থা দেখায়। কিন্তু সেই সম্পর্ক কেন ভেঙে গেল, জানতে চাইলে হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব (আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন কমিটি) মঈনুদ্দীন রুহী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আল্লামা আহমদ শফীর নীতি ও আদর্শ থেকে বর্তমান হেফাজতে ইসলাম বিচ্যুত হওয়ার কারণে সরকারসহ সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। মাওলানা মামুনুল হক গংদের উচ্ছৃঙ্খল বক্তব্য, অরাজনৈতিক সংগঠনের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে সরকার হার্ড লাইনে গেছে।’ কওমি মাদ্রাসা ও আলেম-ওলামাদের প্রতি সরকার সব সময় সহনশীল বলেও মনে করেন মাঈনুদ্দীন রুহী।

তবে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, শাপলা চত্বরের ঘটনার পর আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজত তাদের ভুল স্বীকার করে সহিংসতার পথে না হাঁটার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এরপর সরকার কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দিয়ে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু আহমদ শফীকে ‘নির্যাতন ও হত্যার’ মাধ্যমে পুনরায় উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড শুরু করা হয়। সহিংসতার সঙ্গে যুক্তদের নির্মূল করা সরকারের দায়িত্ব। সেটাই করা হচ্ছে।

কৌশলগত সম্পর্ক থাকবে

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক সংঘাত ও সহিংসতার জন্যই সরকার তাদের ওপর কঠোর হয়েছে, বিষয়টি এত সরল নয়। আহমদ শফীর মৃত্যুর পর জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বে হেফাজতের যে কমিটি হয়, তাতে সরকারঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অংশ বা আনাস মাদানীর অনুসারীরা ঠাঁই পাননি। তাঁরা পাল্টা কমিটি দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেটা আর এগোয়নি।

এদিকে বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন কমিটির কোনো কোনো নেতার সঙ্গে সরকারি মহলের যোগাযোগ থাকলেও ওই কমিটিকে আস্থায় নেয়নি সরকার। হেফাজত নেতারা মনে করছেন, নরেন্দ্র মোদির সফরবিরোধী বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকার হেফাজতকে দমনে নেমেছে।

জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন রোববার বিলুপ্ত করা কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘হেফাজতকে ভুল বুঝে সরকার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে। সরকারকে আমরা শত্রু বলে মনে করি না।’

সরকারসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মামলা-গ্রেপ্তার ও অভিযানের মাধ্যমে হেফাজতকে দুর্বল করা যাবে, তবে একেবারে বিলুপ্ত করা যাবে না। সে জন্য অনুগত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও হেফাজতের সঙ্গে একধরনের কৌশলগত সম্পর্ক সরকার রক্ষা করবে। ভবিষ্যতের এই সম্পর্ক কীভাবে নির্ধারিত হবে, সেটিই এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।