১৭ বছর ধরে রফিয়া খাতুন (৫৫) শয্যাশায়ী। তাঁর অসুস্থ স্বামী নজরুল ইসলাম (৬৯) হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে চার মাস ধরে পঙ্গু। ছোট মেয়ে দিনা আক্তার (২৪) বাড়ি বাড়ি কাপড় বিক্রি করে মা-বাবাকে দেখাশোনা করতেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেই উপার্জনের পথও এখন বন্ধ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দিনার বাবার জন্য একটি হুইল চেয়ারসহ সহযোগিতা চেয়ে পোস্ট দেখতে পান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মাসুম। পরে তিনি একটি হুইল চেয়ার ও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে দিনাদের বাসায় হাজির হন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার মাঝিকাড়া গ্রামের ঘটনা এটি।
আজ বুধবার দুপুরে ইউএনও মোহাম্মদ মাসুম মাঝিকাড়া গ্রামে একটি হুইল চেয়ার ও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে দিনার পঙ্গু বাবা নজরুল ইসলামকে দেখতে যান। তিনি নিজ হাতে দিনার বাবাকে হুইল চেয়ারে বসান। সে সময় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম, সমাজসেবা কর্মকর্তা পারভেজ হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। নজরুল ইসলামকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড দেওয়ার জন্য সমাজসেবা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন ইউএনও।
হুইল চেয়ার পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন দিনার বাবা নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘১৭ বছর ধরে আমার স্ত্রী বিছানায়। আর আমি চার মাস ধরে পঙ্গু। এত দিন কেউ কোনো খোঁজখবর নিল না। আজকে ইউএনও স্যার খাবার ও হুইল চেয়ার দিছেন। আমি ও আমার পরিবার ওনার কাছে কৃতজ্ঞ।’
জানা গেছে, নজরুল ইসলামের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে জাকির হোসেন পেশায় রংমিস্ত্রি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা বাসায় ভাড়া থাকেন। গার্মেন্টস কর্মী ছোট মেয়ে স্বামী ও সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকেন। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া ছোট মেয়ে দিনা আক্তারের ২০১২ সালে চট্টগ্রামে বিয়ে হয়। স্বামী নেশাগ্রস্ত হওয়ায় বিয়ের পরপরই সন্তানসম্ভবা দিনা বাবার বাড়ি নবীনগরে চলে আসেন। জান্নাতুল ফেরদৌস (৭) নামে তাঁর একটি মেয়ে আছে। জান্নাতুল স্থানীয় মাঝিকাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। পরিবারের হাল ধরতে দিনা নারায়ণগঞ্জ থেকে কাপড় এনে বাড়ি বাড়ি বিক্রি শুরু করেন। এতে কোনোভাবে সংসারের খরচ চলে যেত। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে মার্চ থেকেই দিনার কাপড় বিক্রি বন্ধ রয়েছে। পুরো পরিবারটি এ অবস্থায় অসহায় হয়ে পড়েছে।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার সঞ্জয় শীল নামের স্থানীয় এক গণমাধ্যমকর্মী দিনার মা-বাবা ও পরিবারের পুরো বিষয় উল্লেখ করে নিজের ফেসবুকে একটি সাহায্যের আবেদন করেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘নজরুল ইসলাম শিশুদের মতো হাত-পায়ের ওপর ভর করে চলাফেরা করেন। অভাবের সংসারে একটা হুইল চেয়ার কেনার সামর্থ্যও তাঁদের নেই।’ বিষয়টি ইউএনও মোহাম্মদ মাসুমের দৃষ্টিগোচর হয়। এর পরই তিনি আজ দুপুরে হুইল চেয়ার ও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে নজরুল ইসলামের বাড়িতে যান।
আজ বিকেল চারটার দিকে ইউএনও নিজের ফেসবুকে লেখেন ‘মানবতার টানে, মানবিকতার টানে। মাঝিকাড়া এলাকার একটি পরিবারের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে ক্ষুদ্র উপহার। আমরা আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াসে একটু ইচ্ছা ও চেষ্টা করলেই এসব মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারি।’
দিনা আক্তার বলেন, তাঁর মা ১৭ বছর ধরে বিছানায়। নড়াচড়া করতে পারেন না। পাঁচ-ছয় মাস আগেও বাবা হাঁটতে পারতেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় আর করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে না পারায় বাবা এখন পঙ্গু। মা-বাবা ও একমাত্র সন্তান নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। বাসার মালিক এক হাজার টাকা ভাড়া নেন।
দিনা বলেন, ‘পাঁচ ছয় মাস ধরেই বড় ভাই বাসার ভাড়া দিয়ে আসছে। বোনও সাহায্য করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁদের পরিবারেও অভাব। আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে কাপড় এনে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতাম। কিন্তু এখন তা-ও পারছি না। খুবই কষ্টে আছি।’
ইউএনও মোহাম্মদ মাসুম বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে একটি হুইল চেয়ার ও কিছু খাবার দিয়ে এসেছি। তাঁর বাবার প্রতিবন্ধী কার্ড সাত দিনের মধ্যে করা হবে।’ তিনি সমাজের সবাইকে অসহায় এই পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।