হিমালয়ে ফিরে গেল শকুনগুলো

সুস্থ হয়ে ফিরে গেল হিমালয় গৃধিনী শকুন
 ছবি: সাকিব আহমেদ

খুব সকালেই দিনাজপুরের সিংড়া শকুন পরিচর্যাকেন্দ্রে হাজির হলাম। কেন্দ্রটিতে শকুনগুলো দেখে মনটা ভরে গেল। দুই মাস আগেও প্রায় সব কটি শকুন অসুস্থ ছিল। প্রতিটি শকুন এখন সুস্থ। একসঙ্গে ১৯টি শকুন আকাশে ডানা মেলে উড়ে গেল। দিনটি ছিল ৪ এপ্রিল। কী এক অসাধারণ দৃশ্য! শুধু মুক্তির আনন্দই নয়, সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রবল তাড়া। উড়ে যাওয়া দেখে মনে হলো, পুরো আকাশই যেন শাসন করছে পাখিগুলো।

হিমালয় গৃধিনী শকুন হিমালয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাখি। এ প্রজাতি বছরের বেশির ভাগ সময় কাটায় পাহাড়ি এলাকায়। তবে তীব্র শীত পড়লে বরফে হিমালয় অঞ্চলের পুরোটা ঢেকে যায়। এ সময় সেখানে এ জাতের শকুনের খাবারের সংকট দেখা যায়। পাশাপাশি শীত থেকে বাঁচার জন্য এরা দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণ করে। হিমালয় থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল কাছাকাছি। তাই শীতে বিচরণের জন্য এ অঞ্চলই তারা বেছে নেয়।

পরিযায়ন যাত্রার সময় এ প্রজাতির শকুনের জীবন সংকটের মুখে পড়ে। বেশির ভাগ শকুন এ দেশের সীমানায় পৌঁছে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। খাবার না পেয়ে অসুস্থ শকুনগুলো লোকালয়ে ঢুকে যায়। এত বৃহৎ একটি পাখির দেখা পেয়ে সাধারণ মানুষ কৌতূহলী হয়। মানুষ শকুনকে না বুঝে বেঁধে রাখে বা আহত করে।

প্রতিবছর শীতে প্রায় ১০০ শকুন আমাদের দেশে আসে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রংপুর ও নীলফামারী জেলায় এরা বিচরণ করে। এ দেশে এই শকুনের দলটি তিন-চার মাস থাকে। দলটির বেশির ভাগ শকুন অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। এ রকম ঘটনা বহু বছর ধরে চলে এলেও আমরা তা খেয়াল করিনি। তবে এখন ফেসবুকের কল্যাণে শকুন আটকে পড়ার খবর সহজেই পাওয়া যায়।

হিমালয় গৃধিনীর এই অসহায় অবস্থা দেখে বন অধিদপ্তরের নেতৃত্বে আইইউসিএন বাংলাদেশ পাখিটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। ২০১৪ সালে দিনাজপুরের সিংড়া জাতীয় উদ্যানে প্রতিষ্ঠা করা হয় শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যাকেন্দ্র। অঞ্চলভেদে গঠন করা হয় শকুন সংরক্ষণ দল। উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি ছোট স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে আসে এই উদ্ধারকাজে।

গত আট বছরে দুই শতাধিক অসুস্থ শকুন উদ্ধার করা হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। দু-তিন মাস পরিচর্যা শেষে এই উদ্ধারকেন্দ্র থেকে ১৪৯টি শকুনকে আবার প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এসব শকুন ফিরে পেয়েছে তাদের আপন ঠিকানা। প্রজনন মৌসুম কাটিয়ে আবার তাদের পরিবার ফিরে এসেছে এ দেশে। শকুনের মতো একটি পাখি রক্ষায় এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।

বাংলাদেশে সাত জাতের শকুন আছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে রাজশকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গত ৪০ বছরে এই শকুন আর দেখা যায়নি। তাই বাংলাদেশে এখন দুই জাতের আবাসিক শকুন টিকে আছে। এর মধ্যে সরু ঠুঁটি শকুন গত পাঁচ বছরে দেখা গেছে মাত্র তিনটি। আর অন্য প্রজাতিটি হলো বাংলা শকুন। এটি মূলত সিলেটের রেমা কালেঙ্গা আর সুন্দরবনে দেখা যায়। সংখ্যায় মাত্র ২৫০। এ দেশের স্থায়ী প্রজাতির এই শকুন হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ, পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ব্যথানাশক ওষুধ কিটোপ্রোফেন ও ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহার। এ ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে এমন পশু মারা গেলে তা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শকুন বিষক্রিয়ায় প্রাণ হারায়। পরিযায়ী প্রজাতিটির মধ্যে হিমালয় গৃধিনী শকুনটি শীতে দেখা যায়। অন্য দুটি পরিযায়ী প্রজাতি হলো কালা শকুন ও ইউরেশীয় গৃধিনী, যা কালেভদ্রে দেখা মেলে।

সবার সহযোগিতায় এ বছর ১৯টি শকুন আবার বুনো পরিবেশে ফিরে গেল। পায়ে রিং ও ডানায় ট্যাগ পরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের শনাক্তকরণের জন্য। আগামী বছর হয়তো তারা আবার ফিরে আসবে এ দেশে। অসুস্থ শকুন দেশের যেকোনো প্রান্তে পাওয়া গেলে তার খবর পৌঁছে দিন স্থানীয় বন অধিদপ্তরের কাছে। শকুনের মতো একটি বিপন্ন প্রাণী রক্ষায় সবার অংশগ্রহণ খুবই জরুরি।