কক্সবাজার সদর হাসপাতালের হিমঘরে পড়ে আছে চাকমা কিশোরী লাকিংমে চাকমার (১৫) নিথর দেহ। এক দিন দুদিন নয়, টানা ২৫ দিন ধরে। দুই পরিবারের (লাকিংমে ও স্বামীর পরিবার) দ্বন্দ্বের কারণে শেষকৃত্য হচ্ছে না মেয়েটির।
মা–বাবার দাবি, তাঁদের মেয়ে লাকিংমেকে অপহরণের পর জোরপূর্বক বিয়ে এবং পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা প্রিয় সন্তানের (লাকিংমে) মরদেহ গ্রামে নিয়ে শেষকৃত্য করতে চান।
অন্যদিকে লাকিংমের স্বামী দাবিদার আতাউল্লাহর ভাষ্য, তাঁর স্ত্রী লাকিংমে ধর্মান্তরিত হয়ে হালিমাতুল সাদিয়া হয়েছেন। তাঁদের সংসারে ৩৭ দিন বয়সী একটি মেয়েসন্তান রয়েছে। সাদিয়াকে দাফন করতে চান।
ঘটনাটা কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সমুদ্র উপকূলীয় বাহারছড়া ইউনিয়নে। আতাউল্লাহর বাড়ি এই ইউনিয়নের মাথাভাঙ্গা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম নুর আহমদ। বিয়ের আগে আতাউল্লাহ কুমিল্লার একটি গ্যারেজে চাকরি করতেন। এখন টেকনাফ বাসস্টেশনের রমজান আলী মার্কেটের রহমানিয়া থাই ফ্যাশন নামক দোকানে চাকরি করছেন। কিন্তু গতকাল তাঁকে দোকানে পাওয়া যায়নি। দোকানের মালিক দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিন মাস ধরে দোকানে চাকরি করছেন আতাউল্লাহ। কিন্তু দুই দিন ধরে দোকানে আসছেন না আতাউল্লাহ।
একই ইউনিয়নের প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ শিলখালী এলাকার চাকমা পল্লিতে নিহত লাকিংমের বাড়ি। তাঁর বাবার নাম লালা অং চাকমা। লাকিংমে স্থানীয় শাপলাপুর উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত।
কক্সবাজারের একটি আদালত নিহত কিশোরীর ধর্মান্তরকরণ এবং অপহরণের ঘটনা তদন্ত করে শেষকৃত্যানুষ্ঠান করতে দায়িত্ব দেন র্যাব-১৫ কক্সবাজারকে। আদালতের নির্দেশে ইতিমধ্যে তদন্তকাজ শেষের দিকে নিয়ে এসেছে র্যাব। র্যাবের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর জানা যাবে, মেয়েটির মরদেহ শেষ পর্যন্ত কার জিম্মায় যাচ্ছে? শেষকৃত্যানুষ্ঠান কীভাবে হবে?
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শাহীন মো. আবদুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ভিসেরা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য চট্টগ্রামে সিআইডিতে (পুলিশের অপরাধ দমন বিভাগ) পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এলে বলা যাবে মেয়েটি বিষপানে আত্মহত্যা করেছে কি না? হিমঘরে লাশটি পুলিশের হেফাজতে আছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি শেখ মুনীর উল গীয়াস প্রথম আলোকে বলেন, লাশ কে পাবে, তার সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত। আদালতের নির্দেশে ঘটনার তদন্ত করছে র্যাব।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ৯ ডিসেম্বর স্বামী আতাউল্লাহর ঘরে মারা যান লাকিংমে। মারা যাওয়ার ১২ দিন আগে লাকিংমে জন্ম দেন একটি মেয়েসন্তান।
কক্সবাজার শহর থেকে ৭১ কিলোমিটার দূরে (দক্ষিণে) টেকনাফ উপজেলার সমুদ্র উপকূলীয় ইউনিয়ন বাহারছড়া। ইউনিয়নের দক্ষিণ শিলখালী এলাকার চাকমা পল্লিতে বসতি ৭০টি পরিবারের সাড়ে ৩০০ জন চাকমার। গ্রামের লোকজন জীবিকা নির্বাহ করেন সমুদ্রে মাছ ধরে ও পাহাড়ে জুম চাষ করে। গ্রামের পাশের মটকামুরা নামের একটি পাহাড়ের পাদদেশে মৎস্যজীবী লালা অং চাকমার টংঘর। ঘরটি টিন ও পলিথিনের, ঘরের চারদিকে বাঁশের বেড়া। পাঁচ সন্তানের (তিন মেয়ে, দুই ছেলে) মধ্যে দ্বিতীয় মেয়ে লাকিংমে চাকমা।
বাবা লালা অং চাকমার দাবি, এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি তাঁর মেয়ে লাকিংমেকে অপহরণ করে স্থানীয় যুবক আতাউল্লাহর নেতৃত্বে কয়েকজন। এরপর জোরপূর্বক বিয়ে করে হত্যা করা হয়। এখন তাঁদের ধর্মীয় রীতি অনুসারে মেয়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে চান তিনি।
অন্যদিকে স্বামী দাবিদার আতাউল্লাহর দাবি, অপহরণ নয়, স্বেচ্ছায় তাঁরা বিয়ে করেছেন। বিয়ের আগে লাকিংমে ধর্মান্তরিত হন। তার (লাকিংমের) বর্তমান নাম হালিমাতুল সাদিয়া। তাঁরা সাদিয়ার দাফন করতে চান। আতাউল্লাহ বলেন, এত দিন তাঁরা কুমিল্লায় ছিলেন। ছয় মাস আগে স্ত্রীসহ টেকনাফে আসেন। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর বিউটি পারলারে যাওয়া নিয়ে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে রুমে গিয়ে সাদিয়া বিষ পান করে। মারা যাওয়ার ১২ দিন আগে সাদিয়া একটি মেয়েসন্তানের জন্ম দিয়েছে।
আজ রোববার দুপুর ১২টার দিকে মটকামুরা পাহাড়ের লালা অং চাকমার টংঘরে গিয়ে দেখা হয় নিহত লাকিংমের বড় বোন উক্য মে চাকমার (১৮) সঙ্গে। তখন টংঘরের খোলা বারান্দায় বসে মেয়ের জন্য বিলাপ করছিলেন মা কোচিং চাকমা (৪০)। স্বামী লালা অং চাকমা তাঁকে (স্ত্রীকে) শান্ত করার চেষ্টা করছেন।
কোচিং চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়ে লাকিংমেকে সন্ধ্যাবেলায় ঘর থেকে তুলে নেওয়া হয়। এরপর ধর্মান্তরিত করে বিয়ে এবং পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’ বাবা লালা অং চাকমা বলেন, অপহরণের পর কয়েক দিন মেয়েকে টেকনাফে রাখা হয়েছিল। টেকনাফ থানার পুলিশ তখন মেয়েকে উদ্ধার করলে এই পরিণতি হতো না।
তদন্ত প্রসঙ্গে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১৫) কক্সবাজারের অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য আমাদের দিয়েছেন। নিহত কিশোরীর বয়স নির্ধারণসহ বিবাহের যাবতীয় তথ্য–প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রয়োজনে ডিএনএ এবং বিষপান করায় ভিসেরা পরীক্ষাও করা হবে। র্যাব এ ঘটনায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। শিগগিরই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর ঘটনার সত্য–মিথ্যা জানা যাবে।’