সাবেক অর্থমন্ত্রীর প্রয়াণ

হাসিমুখের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, সফল মানুষের বিদায়

আবুল মাল আবদুল মুহিত (১৯৩৪—২০২২)
ফাইল ছবি

আবুল মাল আবদুল মুহিত একজন পরিপূর্ণ ও সফল মানুষ ছিলেন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সফল ছিলেন। উদার, অসাম্প্রদায়িক ও সংস্কৃতিমনা এবং একজন আপাদমস্তক সৎ মানুষ ছিলেন তিনি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১২ বার বাজেট দিয়েছেন। উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সাবেক অর্থমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরাই বলছেন, তাঁর কোনো অপ্রাপ্তি ছিল না। তৃপ্তি নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৬ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন মুহিত। তারপর থেকেই নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।

ওনার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি ছিল না। তৃপ্তি নিয়ে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। দেশকে অনেক কিছুই দিতে পেরেছেন।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের অভিভাবক হারিয়েছি। আলোর দিশারি হিসেবে তাঁকে আমরা মিস করব।
মুহিতের ছোট ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন

সাবেক অর্থমন্ত্রীর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর গুলশান আজাদ মসজিদে। গতকাল শনিবার বেলা ১১টা ৫ মিনিটে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে জানাজা সম্পন্ন হয়। এরপর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আবুল মাল আবদুল মুহিতের মরদেহ রাখা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে ছিল দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় ৪৫ মিনিট। সেখান থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানে বেলা দেড়টায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে মরদেহ নেওয়া হয় বনানীর নিজ বাসায়। এরপর আবুল মাল আবদুল মুহিতের মরদেহ গতকাল বনানীর বাসা থেকে জন্মস্থান সিলেটের উদ্দেশে রওনা হয় বেলা পৌনে তিনটায়। আজ রোববার সিলেটে মা-বাবার কবরের পাশে শায়িত হবেন মুহিত।

সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল মাল আবদুল মুহিতকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রস্তুত করা হচ্ছে মঞ্চ। আজ রোববার দুপুর ১২টায় আবুল মাল আবদুল মুহিতের মরদেহে সিলেটের সব মহলের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হবে।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেট শহরের ধোপাদীঘির পাড়ে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের কর্ণধার আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ও সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান মুহিত। স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তিন সন্তানের মধ্যে কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ। বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং ছোট ছেলে সামির মুহিত শিক্ষক।

গতকাল দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর সময় সাবেক অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন তাঁর একসময়ের মন্ত্রিসভার সহকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলেন, দেশের রাজনীতিতে সৎ মানুষের সংখ্যা খুবই কম। এত অসৎ মানুষের ভিড়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন শতভাগ সৎ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে রেখেছেন অনন্য অবদান। ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। দেশের ইতিহাসে রেকর্ড ১২টি বাজেট দিয়েছেন মুহিত। দেশের অর্থনীতি যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, তাতে মুহিতের অবদান অনস্বীকার্য।

এ সময় প্রয়াত মুহিতের ছোট ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, ‘ওনার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি ছিল না। তৃপ্তি নিয়ে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। দেশকে অনেক কিছুই দিতে পেরেছেন।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের অভিভাবক হারিয়েছি। আলোর দিশারি হিসেবে তাঁকে আমরা মিস করব।’

মুহিতের স্মৃতিচারণা করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, এ দেশের রাজনীতিতে সৎ মানুষ বেশি নেই। তিনি শতভাগ একজন সৎ মানুষ ছিলেন। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশ যে আজকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে; সব ধরনের প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাঁর অনবদ্য ভূমিকা আছে।

শহীদ মিনারে মুহিতকে প্রথম ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দলটির সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। রাষ্ট্রপতির পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাউদ্দিন ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কবির আহমেদ কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিনের পক্ষে সংসদের সার্জেন্ট অ্যান্ড আর্মস কমোডর এম নাইম রহমান শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

শ্রদ্ধা জানাতে এসে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। ওই সময় তিনি প্রবাসীদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন। প্রবাসীদের প্রচেষ্টা না থাকলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি আন্দোলন সম্ভব ছিল না। সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ছাত্র হিসেবে, চাকরিজীবনে এমনকি সরকারের মন্ত্রী হিসেবে সবখানেই তিনি তাঁর কাজটি সফলভাবে করেছেন। তাঁর জীবনে কোনো আক্ষেপ ছিল না। তাঁর মতো সফল মানুষের সংখ্যা খুবই কম। সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘আমি সংস্কৃতিমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর কাছে যতবারই গেছি, ততবারই তাঁর কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। দেশের সংস্কৃতির বিকাশে তাঁর অনন্য ভূমিকা রয়েছে। তিনি জাতির চিন্তাভাবনাকে ধারণ করেছেন। সেটি বাস্তবায়নও করেছেন।’ সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, মুহিতের মতো মানুষ বর্তমান সমাজে খুবই কম। তাঁর মৃত্যু দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বর্তমান সরকারের ভিশন ২০২১ প্রণয়নে সাবেক অর্থমন্ত্রীর বড় ভূমিকা ছিল। এক বিরল ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘যেকোনো বিষয়ে তিনি অনেক গভীরে যেতেন। বাজেটে যার প্রতিফলন দেখতাম। দেশের অর্থনীতি আজ যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, তাতে তাঁর যথেষ্ট অবদান আছে।’ বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, ‘এই যে ছয় লাখ কোটি টাকার বাজেট দেখছি, সেই স্বপ্ন কিন্তু তিনি দেখিয়েছেন।’

সর্বজন শ্রদ্ধা শেষে ভাষাসৈনিকের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানে মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে অর্থমন্ত্রীর ছোট ভাই ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘রোববার সিলেটে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে। পারিবারিক কবরস্থানে দাফন দেওয়ার কথা তিনি বলে গেছেন। সেখানে আমাদের মা-বাবা ও দাদা শায়িত আছেন।’

সিলেটের প্রস্তুতি

সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল মাল আবদুল মুহিতকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রস্তুত করা হচ্ছে মঞ্চ। আজ রোববার দুপুর ১২টায় আবুল মাল আবদুল মুহিতের মরদেহে সিলেটের সব মহলের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হবে। সিলেট সিটি করপোরেশনের শ্রমিকদের গতকাল বিকেল থেকে শহীদ মিনারের অভ্যন্তরে পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে দেখা গেছে।

আজ দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত আবুল মাল আবদুল মুহিতের মরদেহে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বেলা দুইটায় সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। পরে রায়নগর এলাকার পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর দাফন অনুষ্ঠিত হবে। কবরের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে মা সৈয়দা শাহারা বানু চৌধুরী ও বাবা আবদুল হাফিজের কবরের পাশে।

আবুল মাল আবদুল মুহিত যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। পরের বছর একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। সিএসপিতে যোগ দিয়ে তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্ব নেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাঁকে ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট জানান, সাবেক অর্থমন্ত্রীর মৃত্যুতে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ দুই দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর অংশ হিসেবে শনি ও রোববার আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী কালো ব্যাজ ধারণ করবেন।