১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে অশনিসংকেতের মতোই হঠাৎ করে ফোন বেজে ওঠে। এদিন নিজ জন্মভূমি থেকে ক্রোশ ক্রোশ দূরে বেলজিয়ামের কূটনীতিকের বাসায় ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা। ফোন করা হয়েছিল নিজ জন্মভূমিতে তাঁর বাবা এবং বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সপরিবার হত্যার কথা জানাতে। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে হত্যার পরপর শেখ হাসিনাকে নিজ বাসভবন থেকে যত দ্রুত সম্ভব বিতাড়িত করেন সেই বেলজিয়ামের কূটনীতিক। এমনকি বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য তাঁদের নিজ গাড়িও ব্যবহার করতে দেননি তিনি। হঠাৎ করে রাষ্ট্রপতির কন্যা থেকে নিজের অবস্থার এমন পরিণতির কথা কোনো পূর্বাভাসেই বুঝতে পারেননি শেখ হাসিনা। এরপর তাঁর জীবনের পরবর্তী অংশের চড়াই–উতরাইয়ের গল্প বিমুগ্ধ চিত্তে ‘হাসিনা: এ ডটারস টেল’ ডকু ফিকশনের মাধ্যমে দেখেছেন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার দর্শকেরা। গতকাল শুক্রবার কলকাতায় তৃতীয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনকালে ‘নন্দন -১’-এ এটি পুনরায় প্রদর্শন করা হয়। এ সময় এই ডকু ফিকশন মানুষকে এতটাই অনুরণিত করে যে অনেক দর্শক চোখের পানি আটকাতে পারেননি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তথ্য মন্ত্রণালয় ও কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনারের আয়োজনে এ চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের দর্শকদের দারুণ আকর্ষণ করেছে এই ডকু ড্রামা। কিন্তু কলকাতার ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। কেননা শেখ হাসিনার এই গল্পের বেশ কিছু অংশ জুড়ে ছিল ভারতের কথা এবং সেই সঙ্গে বাংলাভাষী এই দর্শকদের মনে বেশ দাগ কেটেছে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার কথাগুলো।
পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এ চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এই ডকুড্রামার পরিচালক পিপলু খান। প্রয়োজনায় রয়েছে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এবং অ্যাপল বক্স ফিল্মস। বিশ্বে বিভিন্ন স্থানে এ ডকুড্রামা সমাদৃত হয়েছে। কেননা এখানে সবার পরিচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদলে বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনার না জানা অনেক কথা উঠে এসেছে। তাঁর জীবনের সত্যিকার চিত্রকে উপস্থাপনে চলচ্চিত্রের পরিচালক তাঁর রান্নাঘর ও লাইব্রেরিতেও ক্যামেরা নিয়ে গেছেন।
চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনার জীবনের উত্থান–পতনের সবকিছু এখানে জীবন্ত রূপ লাভ করেছে। আমি মনে করি, আপনারা সকলে এটি পছন্দ করবেন।’ ৩২টি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র এবার প্রদর্শন করা হবে এ উৎসবে। দর্শক চাহিদার কারণে আগামীকাল রোববার সন্ধ্যায় আরও একবার ‘হাসিনা: এ ডটারস টেল’ ডকুড্রামাটি ‘নন্দন-২’-এ প্রদর্শন করা হবে বলে জানান আয়োজকেরা।
১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের এ ডকুড্রামা তৈরি করতে প্রায় পাঁচ বছর সময় লেগেছে। এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনে বারবার গ্রেপ্তার হওয়ার কথা থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবার হত্যার বিষয়গুলো বর্ণনা করা হয়েছে। স্থানীয় অনেক দর্শকই এ চলচ্চিত্রকে শেখ হাসিনার কাছ থেকে শোনা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলে মনে করছেন বরাবরই যাঁর কেন্দ্রে ছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।
পশ্চিমবঙ্গের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং জৈবপ্রযুক্তিমন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু দুই বাংলার মানুষের জন্য এবং এই বিশ্বের জন্যও সম্পদ ছিলেন। দুই বাংলার মানুষের উচিত সম্মিলিতভাবে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা। যার মাধ্যমে এই মহান ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা জানাতে পারব আমরা।’
এর আগে পর্যটনের জন্য খ্যাত গোয়ায় ভারতের ৫১তম চলচ্চিত্র উৎসে প্রদর্শন করা হয় ‘হাসিনা: এ ডটারস টেল’। চলচ্চিত্রটির আন্তর্জাতিক পরিভ্রমণ প্রসঙ্গে এর পরিচালক পিপলু খান বলেন, ‘অনেকেই মনে করেছিলেন এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ থেকে শুধু বর্ণনানির্ভর একটি কাজ হবে। কিন্তু এখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কোনো বর্ণনা নেই, যা অনেককে অবাক করেছে। তাঁরা অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে, কীভাবে এটিকে প্রথম বিষয় হিসেবে আমি বেছে নিয়েছি।’
সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও নসরুল হামিদের প্রযোজনায় নির্মিত এ চলচ্চিত্রে শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানার বর্ণনায় উঠে এসেছে তাঁদের বাবা এবং পুরো পরিবারকে হত্যার কথা জানার পর কীভাবে তাঁদের পুরো দুনিয়া ওলটপালট হয়ে যায়, কত কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে তাঁরা আবারও বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন যেই দেশের স্বাধীনতার জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন তাঁদের বাবা শেখ মুজিবুর রহমান এবং কীভাবে শেখ হাসিনা আবারও তাঁর নিজ অবস্থান তৈরি করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বিজ্ঞপ্তি