হাল না ছাড়া পরিবারগুলোর গল্প

সাভারে রানা প্লাজা ধসে মাকে হারিয়েছে মাহিয়া। ‘হায়রে মা জননী আমার...’ গাইতে গাইতে একপর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে সে। এ সময় চোখে পানি আসে অন্যদেরও। সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ০৪ মে। ছবি: দীপু মালাকার
সাভারে রানা প্লাজা ধসে মাকে হারিয়েছে মাহিয়া। ‘হায়রে মা জননী আমার...’ গাইতে গাইতে একপর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে সে। এ সময় চোখে পানি আসে অন্যদেরও। সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ০৪ মে। ছবি: দীপু মালাকার

মাহিয়া আক্তারের মা ময়না বেগমের লাশ গলে গিয়েছিল। তাই চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া মাহিয়াকে মায়ের লাশ দেখানো হয়নি। মা-বাবা ঢাকায় কাজ করতেন বলে মাহিয়া বরিশালে দাদির সঙ্গে থাকত। এখনো মনে আছে, রানা প্লাজা ধসে মা মারা যাওয়ার দুই দিন আগে বরিশাল থেকে মাহিয়াকে সাভারে এনেছিলেন মা। মায়ের নাকি মাহিয়াকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। এক মামার সঙ্গে সে এসেছিল। দুর্ঘটনার দিন মা মাহিয়ার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলেন, দোকান থেকে কিছু একটা কিনে খেয়ে নিতে। সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফেরার পথে মাহিয়ার জন্য ভালো খাবার আনবেন। তারপর তো সবই শেষ।

মাহিয়া বর্তমানে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বরিশালে বাবার সঙ্গে থাকে। বাবা আবার বিয়ে করেছেন, তবে নতুন মা বেশ ভালো। কিন্তু নিজের মাকে তো সে ভুলতে পারে না।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান মাহিয়াকে যখন একটি গান গাইতে বললেন, মাহিয়া হায়রে মা জননী আমার...গানটি গাওয়া শুরু করল। একপর্যায়ে মাহিয়ার আবেগে সুর-তাল-লয় ঠিক রাখতে পারল না। মাহিয়ার গানে শুধু মাহিয়া নয়, উপস্থিত সবার চোখে পানি এনে দিল। কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনে প্রথম আলোর প্রশিক্ষণকক্ষে উপস্থিত হওয়া ব্যক্তিরা রানা প্লাজা ধসে কেউ মাকে হারিয়েছে, কেউ বাবাকে হারিয়েছে। কেউ বা নিজেই সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। মাহিয়া শিক্ষাবৃত্তি পাচ্ছে।

রানা প্লাজা ধসের পর ঘুরে দাঁড়ানোর ৬ বছর উপলক্ষে আজ শনিবার মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাহিয়াসহ অন্যরা উপস্থিত হয়েছিল।

রানা প্লাজা ধসে আহত হন শিলা বেগম। নিজের কথা বলতে বলতে চোখে পানি আসে তাঁর। সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ০৪ মে। ছবি: মানসুরা হোসাইন

মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল থেকে রানা প্লাজায় নিহত ২০ পরিবারের ২০ জন শিক্ষার্থী শিক্ষাবৃত্তি পাচ্ছেন। এ ছাড়া পুনর্বাসনের জন্য ১০১ জনকে দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৫০ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা। সহায়তাপ্রাপ্ত ২০ জন শিক্ষার্থী, ১০ জন আহত কর্মী, নিহত পরিবারের সদস্য মিলিয়ে ৩০ জন ক্ষতিগ্রস্ত ও তাঁদের একজন করে অভিভাবকসহ মোট ৬০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এ আয়োজনে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কয়েকজন অনুপস্থিত ছিলেন। 

মায়ের মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে মাহিয়ার পরিবার ৬ লাখ টাকা পেয়েছে। তবে এ টাকা নানা, নানি, মামা, মাহিয়া ও মাহিয়ার বাবার মধ্যে ভাগ হয়েছে। মাহিয়া আর মাহিয়ার বাবা যে ভাগ পেয়েছেন, তা থেকে আগের ঋণ পরিশোধসহ অন্যান্য খরচ মেটাতেই শেষ হয়ে গেছে। কৃষিকাজ বা যখন যে কাজ পান তাই করা বাবার পক্ষে মাহিয়ার পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছে না। মাহিয়া পড়াশোনা শেষ করে চিকিৎসক হতে চায়।

শিলা বেগমের (৩০) মেয়ে তানজিলা আক্তার বলছিল, মা হয়তো তাকে কলেজে পড়ানোর খরচ জোগাতে পারবেন না। এ সময় প্রশিক্ষণকক্ষে শুধু ফোঁপানো কান্নার শব্দ। কাঁদছিলেন শিলা বেগম।
শিলা বেগমের রাজমিস্ত্রির কাজ করা স্বামী মারা গেছেন ২০০৬ সালে। তখন তানজিলার বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। ২০১১ সালে শিলা রানা প্লাজায় একটি পোশাক কারখানায় জ্যেষ্ঠ অপারেটর হিসেবে কাজ নেন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দুর্ঘটনার আগ পর্যন্ত বেতনসহ সব মিলে প্রায় ১২ হাজার টাকা পেতেন। মেয়েকে নিয়ে ভালোই চলে যেত দিন।

শিলা বেগম জানালেন, দুর্ঘটনার সময় তাঁর পেটের ওপর একটি বিম পড়ে, এতে তিনি গুরুতর আহত হন। একটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। মেরুদণ্ড সোজা করতে পারেন না। ডান হাত প্রায় অকেজো। মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। প্লাস্টিকের নল দিয়ে প্রস্রাব-পায়খানা করতে হচ্ছে। সরকারের খরচে টানা দুই বছর চিকিৎসা করতে হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সহায়তায় এখনো চিকিৎসা চলছে। সারা শরীর এখনো একধরনের ব্যান্ডেজে মোড়ানো। দুর্ঘটনার প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর শিলা বেগমকে উদ্ধার করেছিলেন উদ্ধারকর্মীরা।

রানা প্লাজায় আহত হয়েছিলেন আল-আমিন। শোনালেন তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প; জানালেন, তাঁর কষ্ট জয়ের কথা। সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ০৪ মে। ছবি: দীপু মালাকার

শিলা এখন সাভারে বোনদের সঙ্গে থাকেন। মেয়ে তানজিলা বরিশালে থাকে তার বড় খালার কাছে। তানজিলা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, তার ইচ্ছা চিকিৎসক হওয়ার।
শিলা সরকারের কাছ থেকে চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার পাশাপাশি ৮৪ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘এই কটা টাকা দিয়া আর কী হয়? মেয়েরে কাছে রাইখ্যা দুইটা ডাইল-ভাতও মুখে তুলে দিতে পারি না। কলেজে পড়ামু কেমনে?’ প্রথম আলো তানজিলার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, শিক্ষাবৃত্তির নতুন তালিকায় যুক্ত হয়েছে সে।

৩৫ বছর বয়সী মুকুল বেগম তাঁর স্বামী মোয়াজ্জেম হোসেনের লাশ দুর্ঘটনার এক দিন পর পেয়েছিলেন। এই দম্পতির একমাত্র মেয়ে এবার এইচএসসিতে পড়ছে। মুকুল বেগম সাভারে বাবার সংসারে আশ্রয় নিয়েছেন। পোশাকশিল্পের শ্রমিক ছোটবোনের আয়ে চলছে পুরো পরিবার। এক মামার জায়গায় থাকার সুযোগ পেয়েছেন।

বিয়ের ১২ বছরের মাথায় স্বামী মারা যাওয়ায় মুকুল বেগম দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম আলো থেকে ১ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়ে মেয়ের পড়াশোনার বিষয়ে অন্তত কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছেন বলে জানালেন। এ টাকা এফডিআর করে রাখা আছে, মাসে মাসে লাভের টাকা পাচ্ছেন তিনি। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া আর্থিক সহায়তা ভাগ হতে হতে তাঁর পাওনা হয়েছিল ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা, তবে হাতে পেয়েছেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করেছেন। বর্তমানে মুকুল বেগম দরজির কাজ করেন, মামার বেকারিতে কিছু টাকা বিনিয়োগ করেছেন, সেখান থেকে কিছু পাচ্ছেন।

মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল ‘ঘুরে দাঁড়ানোর ৬ বছর’ শীর্ষক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা ও অনুদানপ্রাপ্ত আহত শ্রমিকেরা। সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ৪ মে। ছবি: দীপু মালাকার

ঘুরে দাঁড়ানোর উদাহরণ হিসেবে আল-আমিন জানালেন, তাঁর কষ্ট জয়ের কথা। সংসারে অভাবের কারণে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হলেও পড়তে পারেননি। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রানা প্লাজায় একটি কারখানায় কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজে যোগ দেন। দুর্ঘটনায় রংপুরের আল-আমিনের ডান হাতে ক্ষত এবং ডান পায়ের গোড়ালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছিলেন তা ঋণ শোধ করতে করতেই শেষ হয়ে যায়। চিকিৎসা শেষে আল-আমিন হতাশ হয়ে পড়েন। তবে প্রথম আলোর কাছ থেকে পাওয়া ১ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তায় আবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এ টাকা দিয়ে গ্রামে ১২ শতক ধানি জমি কেনেন। সেই জমি থেকে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে পরিবারের বাবা-মা, ভাই-বোনদের খাবার চলে। তাই আল-আমিনের ওপর চাপ খানিকটা কমে। তিনি রংপুর থেকে টিসি নিয়ে ঢাকায় এসে আবার পড়াশোনা শুরু করেন। এ খরচ চালানোর জন্য বাড়ি বাড়ি সংবাদপত্র বিলি, টিউশনি, কোচিং সেন্টারে কাজ করেছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে এমএ পাস করে বর্তমানে একটি চাকরির পেছনে ছুটছেন এ যুবক।

আল-আমিন প্রথম আলোর কাছ থেকে শিক্ষাবৃত্তি পাওয়াদের কাছে একটাই আহ্বান জানালেন, তা হলো কোনো অবস্থাতেই যেন তাঁরা পড়াশোনা না ছাড়েন। যে করেই হোক পড়াশোনা শেষ করতেই হবে।