সাদা বা ধবল গরুর জন্য মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিমের বেশ পরিচিতি আছে। ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য পুরান ঢাকার ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে থাকত মিরকাদিমের এই গরু। তবে দিন দিন এই গরু হারিয়ে যাচ্ছে। গত বুধবার সরেজমিনে মিরকাদিমের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কথা হয় সাদা গরুর খামারিদের সঙ্গে। তাঁরা এই গরুর ঐতিহ্যের কথা জানান। বর্তমানে কেন এই গরু হারিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়েও কথা বলেন।
মিরকাদিমের গাই গরুর চোখের পাপড়ি সাদা, শিং সাদা, নাকের সামনের অংশ সাদা, পায়ের খুর সাদা, লেজের পশম সাদা, আর সারা শরীর তো সাদাই। প্রতিবছর কোরবানির ঈদে মিরকাদিমের গরু বিক্রি একটি আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। ঢাকার নবাব গণি মিয়ার সময় থেকেই রহমতগঞ্জে চালু হওয়া হাটে তোলা হচ্ছে এই গরু।
নৈদিঘিরপার এলাকার খামারি মস্তফা বলেন, মিরকাদিমের সাদা গরু তৈরিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। ভারত, নেপাল ও ভুটানের বলদ, সাদা ষাঁড় ও সাদা বাচ্চা গাভি কিনে আনেন মিরকাদিমের খামারিরা।
মিরকাদিমের গরুর আকর্ষণের একটি কারণও রয়েছে। এখানকার গরুর ব্যবসায়ী আলী আহম্মদের কাছ থেকে জানা গেল সে কথা। তিনি বলেন, কোরবানির ঈদের জন্য মিরকাদিমের গরুগুলোকে আলাদা করা হতো। নিজেদের খামারে শুধু খইল, বুট, খেসারি, গম ও মসুর ডালের ভুসি, রাব (মিষ্টিগুড়) খেতে দেওয়া হয়। সঙ্গে ভুট্টা চূর্ণ করে দেওয়া হয়। কোনো ঘাস খাওয়ানো হয় না। তাই মিরকাদিমের গরুর মাংসে আঁশ কম থাকে। মাংস একটু নরম ও তেলতেলে হয়। এ কারণে এখানকার গরু পালনে খরচ বেশি। তাই দামও অন্যান্য গরুর চেয়ে বেশি।
মিরকাদিমের গরুর সেই সুদিন আর নেই বলে জানালেন আলী আহম্মদ। তিনি বলেন, এখন গোখাদ্যের দাম বেশি। গরু পালনের জায়গা কমে গেছে। ভারতীয়, নেপালি গরু বাজারে চলে আসায় মিরকাদিমের সাদা গরুর প্রতি খামারিদের আগ্রহ কমে গেছে। তিনি বলেন, ১০ বছর আগে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে ২৫-৩০টি সাদা গাই গরু পালন করতেন তিনি। তবে লাভ কমে যাওয়ায় পেশা বদল করে এখন গরুর মাংসের ব্যবসা করছেন। স্থানীয় লোকজন জানান, এখনো বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে ১০-১৫ জন খামারি তিন থেকে ছয়টি করে এ জাতের গরু পালন করছেন।
খামারি নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘২০০ বছর ধরে বংশপরম্পরায় গরুর ব্যবসা করে আসছি। মধ্যে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আবার শুরু করেছি।
একেকটা গরুর জন্য ৪০০ টাকা খরচ হয় প্রতিদিন। তেমন লাভ না হলেও এই গরু পালন করছি।’ তিনি বলেন, ‘আট মাস আগে ফরিদপুর ও কেরানীগঞ্জের কয়েকটি হাট ঘুরে সাড়ে তিন লাখ টাকায় তিনটি সাদা গরু কিনেছিলাম। খাবার ও ওষুধ মিলিয়ে পৌনে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়। সেই গরুর দাম মাত্র চার লাখ টাকা বলছেন ক্রেতারা।’
গোবিন্দনগরের আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এ বছর বেশি গরু তৈরি করিনি। আমার মাত্র চারটি গরু আছে। গত বছর গরু বিক্রি করে লাভবান হতে পারিনি। কোনোমতে চালান উঠে এসেছে। বিভিন্ন কারণে মিরকাদিমে ধবল গরু মোটাতাজা এখন প্রায় বন্ধ। সামনের বছরগুলোতে এই গরু পাওয়া মুশকিল হতে পারে।’
টেঙ্গর এলাকার কামাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের গরুগুলো ঢাকার রহমতগঞ্জের হাটে (গণি মিয়ার হাট) বিক্রি হয়। সেখানে খুব চাহিদা ধবল গরুর। চার ঘণ্টার মধ্যে গরু বিক্রি হয়ে যায়। তবে যে টাকায় গরু বিক্রি করেছি, তাতে খরচ বাদ দিয়ে লাভের কিছু ছিল না। এবারও চারটি ধবল গরু পালন করেছি। জানি না ভাগ্যে কী আছে।’
রিকাবিবাজার এলাকার গরু খামারি আসলাম বলেন, ধবল গরু মিরকাদিমের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য রক্ষায় খামারিদের প্রতিবছর লোকসান গুনতে হচ্ছে। সরকারিভাবে তাঁদের সহযোগিতা দেওয়া হলে ঐতিহ্যটা টিকিয়ে রাখা যেত।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কুমুদ রঞ্জন মিত্র প্রথম আলোকে বলেন, এই জেলায় কতজন ধবল গরু পালন করেছেন, তার আলাদাভাবে হিসাব রাখা হয়নি। তবে খামারিদের সংখ্যা দিন দিন অনেক কমেছে। তিনি বলেন, এই গরুর খামারিদের ইউরিয়া-মোলাসেস-স্ট্র ( ইউরিয়া সার, রাবগুড় ও শুকনা খড়) দিলে গরু বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মোটাতাজা হবে। খরচও কমবে। ধবল গরু পালনে খামারিদের উৎসাহিত করা হবে। প্রদর্শনীর মাধ্যমে সুন্দর পশুটির মালিককে পুরস্কৃত করা হবে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক আহম্মেদ বলেন, ঐতিহ্য রক্ষায় ধবল গরু পালনে খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হবে। ওষুধ ও ডাক্তারি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হবে।