হাত ধুতে কার্যকর সোপি ওয়াটার, খরচ ৫ টাকা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে হাত ধোয়ার জন্য দামি সাবান বা স্যানিটাইজারের বিকল্প হিসেবে ডিটারজেন্ট দিয়ে তৈরি ‘সোপি ওয়াটার’ বা সাবান–পানি ব্যবহার করা যায়। মাত্র পাঁচ টাকা খরচে একটি পরিবারের এক সপ্তাহের বেশি সময়ের হাত ধোয়ার বন্দোবস্ত হতে পারে। 

এবার সেই সোপি ওয়াটারের কার্যকারিতা স্বীকৃতি পেল সাবান বা স্যানিটাইজারের বিকল্প হিসেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউনিসেফের তৈরি সর্বশেষ নির্দেশিকায় এই স্বীকৃতি দিয়েছে। আর নির্দেশিকাটি প্রকাশিত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার।

সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বিকল্প হিসেবে সোপি ওয়াটারের ব্যবহার বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই হয়ে আসছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। কিন্তু ডব্লিউএইচওর মতো প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষের জন্য এক ‘যুগান্তকারী’ বিষয় বলে মনে করেন পানি ও স্যানিটেশন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সোপি ওয়াটারের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ এ জন্যই যে এযাবৎ এর কার্যকারিতা নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে, এর সব কটির নেতৃত্ব দিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)।

ডব্লিউএইচওর স্বীকৃতির পর এখন স্যানিটেশন–সংক্রান্ত সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচিতে সোপি ওয়াটারকে যুক্ত করতে চায় সিটি এলাকার বাইরে মানুষের পানি ও স্যানিটেশনের বিষয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।


সোপি ওয়াটারকে সাবান–পানিও বলা হয়। বাজারে পাওয়া যেকোনো ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়েই বানানো সম্ভব এই সোপি ওয়াটার। ২০০৮ সালে কেনিয়ার স্কুলে শিক্ষার্থীরা প্রথম এর ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু ওই দেশটিতে এর উপযোগিতা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি, কোনো দেশেই হয়নি।

আইসিডিডিআরবির এনভায়রনমেন্টাল ইন্টারভেনশনস ইউনিট ২০১০ সাল থেকে এ নিয়ে একের পর এক গবেষণা পরিচালনা করতে থাকে বলে জানান ইউনিটের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, এই অতিসাশ্রয়ী সাবান–পানি তৈরির কৌশলও। দেড় লিটার পানির মধ্যে বাজারে পাওয়া কোনো ডিটারজেন্ট চার চা-চামচ মিলিয়ে ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল। আর পুরো বিষয়টির জন্য সময় দরকার এক মিনিট, অর্থ খরচ পাঁচ টাকা।

মাহবুবুর রহমান বলছিলেন, ‘এমন সময় এ স্বীকৃতি এল, যখন হাত করোনার মতো ভয়ংকর মহামারিতে আমরা আক্রান্ত। আর এখন জীবন রক্ষার একটি অপরিহার্য শর্তে পরিণত হয়েছে হাত ধোয়া। দেশের নিম্ন আয়ের অসংখ্য মানুষ চাইলেও সাবানের ব্যবহার করতে পারে না। বিকল্প হিসেবে সোপি ওয়াটারের ব্যবহার ছিল অনেকের মধ্যে। তবে এখন এই স্বীকৃতি একটি বড় অর্জন।’

ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, যেখানে অ্যালকোহলপূর্ণ স্যানিটাইজার বা সাবান সম্ভব নয়, সেখানে ডিটারজেন্টের সঙ্গে পানির মিশ্রণে তৈরি তরল ব্যবহার করা যায়। পানি ও ডিটারজেন্ট অনুপাত কেমন হবে, তা স্থানীয়ভাবে প্রাপ্য পণ্যের ওপর নির্ভর করবে।

হাতের জীবাণু নাশ করার ক্ষেত্রে সোপি ওয়াটারের কার্যকারিতা নিয়ে ট্রায়াল করেছেন আইসিডিডিআরবির সহকারী বিজ্ঞানী নূহ আমিন। তাঁর গবেষণা আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, দেড় লিটার পানির মধ্যে চার চা-চামচ ডিটারজেন্টের মিশ্রণ সাবান বা তরল হ্যান্ড ওয়াশের মতোই কার্যকর। নূহ আমিন আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পানি ও ডিটারজেন্টের অনুপাত, দীর্ঘ মেয়াদে এর কার্যকারিতা—এই সবই আমরা গবেষণায় দেখিয়েছি। পুরো গবেষণা প্রক্রিয়া আইসিডিডিআরবিই এ পর্যায়ে নিয়ে গেছে।’

করোনা থেকে দূরে থাকতে হাত ধোয়ার ব্যাপক প্রচার আছে। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি তৈরি বহু নির্দেশক গুচ্ছ জরিপে (মিকস) বলা হয়েছে, দেশের ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ ঠিকমতো হাত ধোয় না। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে এ জরিপ প্রকাশিত হয়। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বিবিএস এই জরিপ করে।

দেশে দরিদ্র ও চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান খায়রুল ইসলাম মনে করেন, শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, বিশ্বের জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ডব্লিউএইচওর এ স্বীকৃতি যুগান্তকারী বিষয়। এটি অসম্ভব কার্যকর কিন্তু ব্যয়সাশ্রয়ী একটি উপাদান। এখন জনস্বাস্থ্য খাতে এর প্রসার দরকার। একে জনপ্রিয় করা দরকার।

গবেষকেরা বলছেন, সোপি ওয়াটার বাসাবাড়িতে যেমন উপযোগী, তেমনই উপযোগী বাজার-হাট, বাসস্ট্যান্ডের মতো লোকসমাগম স্থলে এবং হাসপাতাল, স্কুলের মতো জনপ্রতিষ্ঠানে।

এবার করোনার সংক্রমণ শুরুর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই হাজার হাত ধোয়ার বেসিন করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)।

জনসমাগম স্থলে সাবান বা লিকুইড সোপ দেওয়ার ক্ষেত্রে হারিয়ে যাওয়া ও অযথা নষ্ট হওয়াসহ নানা সমস্যার কথা জানান প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান। তিনি এখন সোপি ওয়াটারকে এসব স্থলে ব্যবহারে উদ্যোগী হবেন বলে জানান। সাইফুর রহমান বলছিলেন, ‘জনস্বাস্থ্যের নিরিখে সোপি ওয়াটার ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ডব্লিউএইচওর স্বীকৃতি একটা বড় ঘটনা। আমরা একে জনপ্রিয় করতে এখন কর্মসূচি নেব।’