বরিশালের মো.সোহেলের খামারে ১৩টি গরু। গরুর জন্য ঘাস কাটার মেশিন মেরামত করছিলেন ৪৩ বছর বয়সী সোহেল। তখন বিদ্যুৎ না থাকলেও মেশিনে বিদ্যুতের লাইন দেওয়া ছিল। তিনি তা খেয়াল করেননি। হুট করে বিদ্যুৎ চলে এলে মেশিনে সোহেলের বুড়ো আঙুলসহ বাঁ হাতের তিনটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
দুর্ঘটনার পর তিন ছেলের বাবা সোহেল শুধু ভেবেছেন, যে করেই হোক তাঁর আঙুলগুলো আবার জোড়া লাগাতেই হবে। কাটা অংশগুলোসহ তিনি প্রথমে যান বরিশালের শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে কোনো সমাধান না পেয়ে এক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় রওনা দেন। তিনিই সব ঠিক করে দেন কোথায়, কার কাছে যেতে হবে।
সোহেলের দুর্ঘটনাটি ঘটে গত ৩০ জুন দুপুরে। ঢাকা পর্যন্ত আসতে রাত হয়ে যায়। তবে তারপরও সোহেলের কপাল ভালো ছিল বলে ওই রাতেই কাটা আঙুল জোড়া লাগানোর অস্ত্রোপচারটি করতে পেরেছিলেন চিকিৎসক অভিজিত সরকার।
যেকোনো দুর্ঘটনার পাশাপাশি ঈদের দিন পশু কোরবানির সময় এ ধরনের আঙুল বা কবজি কেটে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। তাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গার চিকিৎসকেরা অগ্রিম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছেন।
কোরবানির সময়সহ যেকোনো দুর্ঘটনায় আঙুল বা কবজি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। এমনটা হলে কোথায় যেতে হবে, তা নিয়ে ফেসবুকে কুমিল্লার পিপলস হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক (অর্থ) মো. কামরুল ইসলাম একটি পোস্ট দিয়েছেন মাসখানেক আগে। পোস্টে এই চিকিৎসক তাঁর মুঠোফোন নম্বরটিও দিয়েছেন।
ওই নম্বরেই কথা হলো কামরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কাটা অঙ্গ রিকনস্ট্রাকশন বা পুর্গঠনের বিষয়টি এখনো অনেকেই জানেন না। চিকিৎসকদের অনেকের মধ্যেও এ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই। তাই তিনি পোস্টটি দিয়েছিলেন এবং পোস্টের পর ভালো সাড়া পেয়েছেন। অনেকে মুঠোফোনে ফোন করে তাঁর এলাকায় কার কাছে বা কোথায় যাবেন, তা জেনে নিচ্ছেন।
এই চিকিৎসক জানান, তাঁদের ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ আছে, যার সদস্যরা এ অস্ত্রোপচার করেন। কেউ জানতে চাইলে লিংক করে দেওয়া হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক সার্জন মো. আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কোরবানির ঈদে তাঁরা প্রস্তুত হয়েই থাকেন যে গরুর শিংয়ের গুঁতা খাওয়া, গরুর লেজে ধরতে গিয়ে গরুর লাথি খাওয়া আর কোরবানির সময় চাকুতে হাত কেটে ফেলা রোগী আসবেই। তবে ঈদের সময় শুধু এ ধরনের কতজন রোগী আসে, সেভাবে আলাদা করে হিসাব রাখা সম্ভব হয় না।
আবাসিক সার্জন আলাউদ্দিন জানান, রিকনস্ট্রাকশন সার্জারির কোনো রোগী থাকলে তাদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য বলছে, গত বছর আঙুল ও কবজি কাটা মোট ১২ জনের রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি হয়েছে, এর মধ্যে পাঁচটি সফল হয়।
আঙুল বা কবজি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সতর্ক থাকতে হবে
চিকিৎসকেরা বলছেন, হাত, পা বা শরীরের কোনো অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হলে কিছু নিয়ম মানলে এই কাটা অঙ্গ আবার জোড়া লাগানো সম্ভব। সরু রক্তনালি অস্ত্রোপচার করে কত সূক্ষ্মভাবে তা জোড়া লাগানো যায়, তার ওপর সফলতা নির্ভর করে।
তবে কাটা অঙ্গ থেঁতলে গেলে তা জোড়া লাগানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া জীবনসংশয়ের আশঙ্কা থাকলে আগে রোগীর জীবন বাঁচাতে হয়। তারপর কাটা অঙ্গ জোড়া লাগানোর চেষ্টা করার বিষয়টি সামনে আসে।
শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অঙ্গটি দ্রুত স্যালাইনে ভেজানো একটি কাপড় বা ব্যান্ডেজের গজ দিয়ে মোড়াতে হবে। পরে ব্যান্ডেজে মোড়ানো অঙ্গটি শুকনা একটি ব্যাগে ভরে মুখ ভালো করে বন্ধ করে দিতে হবে। তারপর আরেকটি পলিথিন বা কনটেইনারে আলাদা করে বরফ নিতে হবে। দুটি ব্যাগ পাশাপাশি রাখতে হবে, তবে খেয়াল রাখতে হবে কোনোভাবেই যাতে বরফ বা পানিতে কাটা অঙ্গটি মিশে যেতে না পারে।
৩০ জুন দুর্ঘটনায় তিনটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হওয়া মো. সোহেলের সঙ্গে গত বুধবার কথা হয় রাজধানীর সিটি হাসপাতালে। জানান, চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী তাঁর আঙুল তিনটি আবার জোড়া লাগতে পারে, আবার তিনি নিজের হাতেই সব কাজ করতে পারবেন। তবে এ জন্য দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে হবে। ঈদ করতে আপাতত বরিশালে বাড়ি গেছেন মো. সোহেল।
মো. সোহেলের রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি করেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) কনসালট্যান্ট অভিজিত সরকার। তিনি সিটি হাসপাতালেও কনসালট্যান্ট হিসেবে (প্রাইভেট) দায়িত্ব পালন করছেন। মো. সোহেলের অস্ত্রোপচার করেন সিটি হাসপাতালে।
অভিজিত সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯ সালের শেষের দিক থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তিনি ২৫টি এ ধরনের অস্ত্রোপচার করেছেন। সফলতার হার ৬৫ থেকে ৭০।
অভিজিত সরকার বলেন, শরীরের বিচ্ছিন্ন আঙুল স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ১২ ঘণ্টা ভালো থাকে আর পাশে বরফের প্যাকেট থাকলে ২৪ ঘণ্টা ভালো থাকে। অন্যান্য বিচ্ছিন্ন অংশ ৬ ঘণ্টা আর বরফ থাকলে ১২ ঘণ্টা ভালো থাকে। বুড়ো আঙুল হলে, রোগী শিশু হলে যত ঝুঁকিই থাকুক রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি করার কথা চিকিৎসাশাস্ত্রেই বলা আছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি থাকলে সাধারণত অস্ত্রোপচার করা হয় না।
অস্ত্রোপচার সফল হবে কি না, তা–ও বলার উপায় নেই, তাই রোগীকে কাউন্সেলিংও করতে হয়। বেসরকারি হাসপাতালে একেকটি অস্ত্রোপচারে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লেগে যায়। একেকটি অস্ত্রোপচারে সময় লেগে যায় ৯ থেকে ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত। তাই চিকিৎসকদের অনেকেই এ ধরনের অস্ত্রোপচারে উৎসাহী হন না।
গত ১৫ মে সকালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় আসামি ধরতে গেলে আসামিরা পুলিশ কনস্টেবল জনি খানের বাঁ হাতের কবজি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তৎপরতায় জনি খানকে ঢাকায় আনা হলে তাঁর অস্ত্রোপচার করেন নিটোর সহযোগী অধ্যাপক সাজেদুর রেজা ফারুকি। তিনি দীর্ঘ সাড়ে ৯ ঘণ্টায় অস্ত্রোপচারটি করেছিলেন রাজধানীর বেসরকারি আল মানার হাসপাতালে।
সাজেদুর রেজা ফারুকি কত শতাংশ অস্ত্রোপচার সফল, সেভাবে চিন্তা না করে একজনের বেলাতেও যদি সফল হয়, তা–ই অনেক বড় বিষয় বলে ভাবতে চান। আঙুল বা কবজি বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া এবং কাটা অংশ যথাযথভাবে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।
ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের চিকিৎসকেরা সরকারি হাসপাতালে এ ধরনের অস্ত্রোপচারের যথাযথ ব্যবস্থা থাকার বিষয়টিতে জোর দিলেন। এ ছাড়া রোগীর পুনর্বাসন জরুরি বলেও উল্লেখ করেন।