কারও বিরুদ্ধে একই সময়ে একাধিক মামলা হলে গ্রেপ্তারের পর থেকে সাজার রায় ঘোষণার আগে পর্যন্ত তিনি যত দিন কারাগারে ছিলেন (হাজতবাস), তা প্রতিটি মামলার মোট সাজা থেকে বাদ যাবে। ২০১৭ সালে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে এটি বলা হয়েছিল। ফৌজদারি সব মামলার ক্ষেত্রে আসামিরা এই সুবিধা পাবে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। তবে হাইকোর্টের নির্দেশনার দুই বছর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন বলছে, ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপনের কারণে কারাগারে আটক বন্দীদের সাজা নির্ধারণের ক্ষেত্রে কারা অধিদপ্তরের অসুবিধা হচ্ছে।
২০১৭ সালের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘যদি একজন আসামি একই সময়ে একাধিক বিচারাধীন মামলায় আটক হয়ে কারা হেফাজতে অবস্থান করে, সে ক্ষেত্রে প্রতিটি মামলায় আসামি কবে প্রথম গ্রেপ্তার হয়ে কারা হেফাজতে অবস্থান করা শুরু করেছে এবং/অথবা জামিনের শর্ত ভঙ্গের জন্য গ্রেপ্তার হয়ে সময়ে সময়ে কারাগারে অবস্থান করছে, তার মোট সময়কাল প্রত্যেক মামলার মোট কারাদণ্ডের মেয়াদ হতে বিয়োগ করতে হবে। কেননা, একজন আসামি প্রতিটি আলাদা মামলায় যে কারাদণ্ড প্রাপ্ত হয়, তার প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে ৩৫-এ ধারায় প্রদত্ত সুবিধা ভোগ করতে অধিকারী।’
এই প্রজ্ঞাপনের কারণে বিভিন্ন অসুবিধার কথা জানিয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর কারা অধিদপ্তর থেকে বিষয়টি স্পষ্ট করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে হাইকোর্ট বিভাগ ৩ অক্টোবর ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপনটি স্থগিত করেন।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েদিদের সাজা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এখন থেকে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসরণ করা হবে। ২০১৭ সালে জারি করা প্রজ্ঞাপনটি হাইকোর্ট বিভাগ স্থগিত করেছেন।
হঠাৎ করে কেন এ বিষয়টি আলোচনায় এল জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধভাবে অর্থের লেনদেনের অভিযোগে করা মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাজার বিষয় নির্ধারণ করতে গিয়ে ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি সামনে আসে।
গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ২০০৭ সালের ৩১ জুলাই থেকে থেকে কারাবন্দী। অস্ত্র মামলায় ১০ বছর, অর্থ পাচারের দুই মামলায় ৭ বছর করে, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় ১৩ বছর এবং আরও একটি মামলায় গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ৩ বছর কারাদণ্ড হয় বলে জানান তাঁর আইনজীবী জাহেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, চার মামলায় তাঁর সাজা খাটা শেষ হয়ে গেছে। যে মামলায় ১৩ বছর সাজা হয়েছে, সেটিসহ তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া সব মামলাতেই (১৯টি) তিনি জামিনে আছেন। হাইকোর্টের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সাজা নির্ধারণ করা হলে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাজা খাটা গত জুলাই মাসে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সরকার তাঁকে মুক্তি দিচ্ছে না।
হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছিলেন, ১৮৯৮ এর ৩৫–এ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে সশ্রম বা বিনাশ্রম যেকোনো প্রকারের কারাদণ্ডের রায়ে মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কারা হেফাজতে অবস্থানের সময়কাল আসামির মোট দণ্ডের সময়কাল থেকে বিয়োগ হবে। যদি একই অপরাধের জন্য মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় আসামির কারা হেফাজতে থাকার সময় মোট দণ্ডের সময়ের বেশি হয়, তবে আসামি তার দণ্ড ভোগ করেছে বলে গণ্য হবে এবং অন্য কোনো অপরাধের কারণে কারাগারে আটক রাখার প্রয়োজন না হলে তাকে দ্রুত মুক্তি দিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে আসামিকে যদি কারাদণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়, তাহলে আসামির ওই অর্থদণ্ড মওকুফ হয়েছে বলে গণ্য হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, কারাগারের জেল সুপার ও জেলাররা ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই বলে আসছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ীই আসামির সাজা নির্ধারণ না হলে জটিলতা বাড়বে। ওই প্রজ্ঞাপন মানতে গেলে একাধিক মামলার আসামি সাজার মেয়াদ পুরো না করেই কারাগার থেকে বের হয়ে যাবে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই যে কোনো আসামি একটি মামলায় হাজতবাস করলেই তার সব মামলা থেকে সেই হাজতবাস বাদ যাবে।
২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) মোস্তফা কামাল পাশা প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধিতে বিষয়টি নির্দিষ্ট করা নেই, সেহেতু একটি মামলার ক্ষেত্রেই হাজতবাস বিয়োগ করা হবে। ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপনের কারণে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের হাজতবাস বিয়োগ করা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এটি নিরসন করা দরকার ছিল।
তবে ২০১৭ সালে হাইকোর্ট যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলেন, তা–ই কার্যকর থাকা উচিত ছিল বলে মনে করেন বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো আসামির বিরুদ্ধে একই সময়ে একাধিক মামলা হলে প্রতিটি মামলা থেকে আসামির হাজতবাসের সময় বাদ দেওয়া উচিত। হঠাৎ করে এই আদেশ স্থগিতের কারণ যদি হয় কোনো বিশেষ কারাবন্দীর জন্য, তবে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হবে। এটি আইন অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়। ফৌজদারি কার্যবিধিতে বিষয়টি স্পষ্ট না থাকার সুযোগ এ ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে বলেই মনে করেন তিনি।