বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তার লাশ উদ্ধারের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ভয়ংকর অপরাধী চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। তারা কয়েক বছর ধরে র্যাব ও ডিবি পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে টাকা আদায় করত। চাহিদামতো টাকা দিতে না পারলে খুন করতেও দ্বিধা করত না তারা। র্যাব ও ডিবি পরিচয়ে অপহরণ করে টাকা আদায় ও নির্যাতনের অন্তত ১০টি ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন চক্রের সদস্যরা।
ঘটনার শুরুটা গত ১৪ জুলাই। সেদিন সকালে রাজধানীর নাখালপাড়ার বাসা থেকে উত্তরায় অফিসে যাওয়ার কথা বলে বের হন বাইং হাউসের কর্মকর্তা সুলতান হোসেন (৪৬)। দুপুরে তাঁর মুঠোফোনে কল দেন স্ত্রী অরিন পারভীন। কিন্তু ফোন বন্ধ পান। রাতেও বাসায় না ফেরায় বিষয়টি সুলতানের বড় ভাই আবুল হোসেনকে জানান। সেই রাতে আর ফেরেননি তিনি। পরদিন (১৫ জুলাই) সুলতানের বড় ভাই তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
জিডি করার পরদিন ওই বাইং হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল মাহমুদ ফোন করে আবুল হোসেনকে জানান, সুলতানের মরদেহ পাওয়া গেছে। লাশ পড়ে আছে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানা এলাকার হাইওয়ের পাশে। লাশ উদ্ধারের দুই দিন পর তেজগাঁও থানায় আবুল হোসেন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে হত্যা মামলা করেন। প্রথমে মামলার তদন্ত করে তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল মান্নান। রহস্য উদ্ঘাটন না করতে পারলেও তিনি নিশ্চিত হন, ঘটনার দিন রাজধানীর পল্লবী পর্যন্ত সুলতানের মুঠোফোন সচল ছিল। এরপর তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
থানা-পুলিশের পাশাপাশি মামলাটির ছায়া তদন্ত করছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের গুলশান বিভাগ। তদন্ত করতে গিয়ে ভয়ংকর একটি চক্রের সন্ধান পায় ডিবি। ঘটনার প্রায় এক মাস পর চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আরও দুজনকে ধরা হয়। ছয়জনের মধ্যে দুজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এই খুনের সঙ্গে চক্রের সাত সদস্য জড়িত ছিলেন। একজন এখনো পলাতক।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আসামি ফরহাদ হোসেন ও জালাল উদ্দিনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাইং হাউস কর্মকর্তা সুলতান সেদিন প্রথমে নাখালপাড়া থেকে মতিঝিলে যান। সেখানে একটি মানি এক্সচেঞ্জ অফিস থেকে বের হওয়ার পর তাঁকে অনুসরণ করতে শুরু করেন চক্রের সদস্যরা। সুলতান একটি বাসে উঠলে ওই সদস্যরা বাসে ওঠেন। পল্লবী এলাকায় তিনি বাস থেকে নামার পর চক্রের সদস্যরা নিজেদের র্যাব পরিচয় দিয়ে তাঁর দিকে অস্ত্র তাক করেন। এরপর তাঁকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। সেখানে তাঁর দেহ তল্লাশি করে সঙ্গে থাকা ১২ হাজার টাকা কেড়ে নেওয়া হয়। ভুয়া র্যাবের খপ্পরে পড়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে সুলতান চিৎকার শুরু করেন। তখন চক্রের সদস্যরা গলায় গামছা পেঁচিয়ে সুলতানকে হত্যা করে লাশ মানিকগঞ্জে ফেলে আসেন।
র্যাব-পুলিশ পরিচয় দেওয়া একটি চক্র গড়ে তোলেন আকবর আলী। তিনি একসময় গুলিস্তানে হকারের কাজ করতেন।
সুলতান হত্যাকাণ্ডের পর ছায়া তদন্ত করতে থাকা ডিবির গুলশান বিভাগ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে খুনিদের অবস্থান জানতে পারে। পরে পল্টন থেকে চক্রের নেতা আকবর আলী, সদস্য সবুজ ও সাহারুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। আকবরের কাছে পাওয়া যায় একটি অস্ত্র। এই চক্রের প্রধান কাজী মো. আকবর আলী। তাঁর বাড়ি খুলনায়। তাঁর নামে চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় ছয়টি মামলা আছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চক্রটির প্রধান আকবর একসময় গুলিস্তানে হকারি করতেন। তখন চুরিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। এরপর ঢাকা থেকে চলে যান চট্টগ্রামে। সেখানেও তিনি চুরি, ছিনতাই, অপহরণসহ নানা অপরাধে জড়ান। আকবরের নেতৃত্বে থাকা চক্রটি এমন লোকদের টার্গেট করত, যাঁদের ব্যবসায় ফাঁকফোকর আছে।
আদালতে প্রতিবেদনে ডিবি বলেছে, সুলতান হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিরা ভুয়া র্যাব ও ডিবি পরিচয় দিয়ে সাধারণত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তোলা লোকদের টার্গেট করেন। কখনো মাইক্রোবাস, কখনোবা অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাতা-পা বেঁধে টাকাপয়সা নিয়ে নিতেন। কাউকে কাউকে হত্যা করতেন।
সুলতানের একমাত্র মেয়ের বয়স ছয় বছর। হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে বাবার বাড়ি রাজবাড়ী চলে গেছেন।
সুলতান হত্যায় জড়িত সবার ফাঁসি চান তাঁর বড় ভাই আবুল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আর যেন এমন ভয়ংকর অপরাধী চক্রের হাতে কেউ না মারা যায়।’