সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় হঠাৎ পরিবর্তনে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সরকারি দলের বাইরে ভিন্নমত পোষণ করা পরিচালক ও পেশাদার ব্যাংক কর্মকর্তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। মুখ খুলতে চাইছেন না ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চুপ।
এদিকে সোমবার রাতেই তড়িঘড়ি করে এসআইবিলের নতুন চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডির অনুমোদন ফাইলে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন গভর্নর ফজলে কবির। পরিবর্তনের পর ব্যাংকটির গ্রাহকেরা গতকাল প্রধান কার্যালয় ও শাখায় ভিড় করেছেন। গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেছেন নতুন চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও এমডি। এ সময় ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খানও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত তিন ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় হঠাৎ পরিবর্তন আসে। ২০১৬ সালের শুরুতে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংক এবং সব শেষ গত সোমবার এসআইবিএলে এমন পরিবর্তন আসে। তিনটি ব্যাংকেই শেয়ার কিনে মালিকানায় এসেছে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ।
ব্যাংক খাতের শীর্ষ ব্যক্তিরা বলছেন, যে পদ্ধতিতে ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তাতে গ্রাহকদের আস্থা হারিয়ে যাবে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে ব্যাংকের মালিকপক্ষও। এর প্রভাব পড়বে পুরো আর্থিক খাতে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলোতে পর্ষদ সদস্যের পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা ব্যাংক খাতের সুশাসনের জন্য অন্তরায়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের বিশ্লেষণ জানতে চাইলে গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রথমত শেয়ারহোল্ডাররা পরিবর্তন করে থাকলে আপত্তি করার কিছুই নেই। কারণ শেয়ারহোল্ডাররা তা পারেই। দ্বিতীয়ত, এসআইবিএল ও ইসলামী ব্যাংক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত থাকায় সরকারের দিক থেকে ব্যাংক দুটিকে তা অব্যাহত রাখতে দেওয়া ঠিক হচ্ছিল না।’
গতকাল মঙ্গলবার মতিঝিলের সিটি সেন্টারে এসআইবিএলের প্রধান কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, নতুন চেয়ারম্যান আনোয়ারুল আজিম আরিফ ও নতুন এমডি কাজী ওসমান আলী অফিসে আসেন সকালে। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিব জে কিউ এম হাবিবুল্লাহ। বেলা দেড়টার দিকে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান, এসআইবিএলের চেয়ারম্যান ও এমডি বাংলাদেশ ব্যাংকে যান। ভাইস চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
প্রথমে তাঁরা গভর্নর ফজলে কবির এবং পরে ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামানের
সঙ্গে দেখা করেন। ঠিক আড়াইটার দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ছেড়ে যান তাঁরা। গাড়িতে ওঠার সময় আরাস্তু খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘গভর্নরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। এসআইবিএলের নতুন চেয়ারম্যান, এমডিও এ সময় ছিলেন।’
এদিকে ব্যাংকটিতে পরিবর্তনের পর গতকাল সকাল থেকেই প্রধান কার্যালয়সহ শাখাগুলোতে ভিড় করেন গ্রাহকেরা। হঠাৎ পরিবর্তনের পর কী হবে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছে তা জানতে চান সবাই। তবে নতুন করে কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় গ্রাহকদের কিছু জানাতে পারেননি কর্মকর্তারা। ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল, ফরেন এক্সচেঞ্জ ও করপোরেট শাখার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রাহকেরা সকাল থেকেই খবর নিতে আসছেন। অনেকে জানতে চাইছেন আগের মতো সুবিধা মিলবে কি না। আমানত রাখছেন এমন অনেক গ্রাহকও আসছেন। সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
এসআইবিএল সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের পর পরিচালকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মিথ্যা তথ্য দিয়ে পরিচালক হওয়া, ব্যাংক পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা, পরিচালকদের বেনামি ঋণ নেওয়াসহ নানামুখী সংকটে পড়ে এসআইবিএল। আগের গভর্নর আতিউর রহমান পরিচালকদের ডেকে তখন মীমাংসা করে দেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব নেন রেজাউল হক। এরপর থেকে ব্যাংকটির পরিস্থিতি ভালো হতে শুরু করে।
১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করা এসআইবিএলের শাখা ১৩৫। ২০১০ সালে আমানত সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা হলেও বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। ২০১০ সালে ব্যাংকটির নিট মুনাফা ছিল ৬৪ কোটি টাকা, গত বছর তা বেড়ে হয়েছে ২২৯ কোটি টাকা।
হঠাৎ সক্রিয় বাংলাদেশ ব্যাংক
এসআইবিএল ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত নতুন পরিচালক ও এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নিলেও এসআইবিএলের ক্ষেত্রে এক রাতেই অনুমোদন দিয়ে দেয়। গত সোমবার দুপুরে ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও এমডি নিয়োগ হয়। একই দিন ৫টার পর অনুমোদনের আবেদন যায় বাংলাদেশ ব্যাংকে। এর আগে থেকেই জরুরি ফাইলের অনুমোদন দিতে হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়ে রাখা হয়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের রাত ১০টা পর্যন্ত অফিস করতে হয়। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে অনুমোদন হয়। গভর্নর, ডেপুটি গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়েন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার নতুন এমডি নিয়োগের জন্য একটি আবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠিয়েছিল বেসিক ব্যাংক। সপ্তাহ হতে চললেও এর অনুমোদন এখনো দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এসআইবিএলে পরিবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য জানতে গতকাল যোগাযোগ করা হয় নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহার সঙ্গে। তিনি গভর্নরের সঙ্গে কথা বলে জানান যে যা বলা হবে এর বাইরে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। পরে তিনি বলেন, ‘কোম্পানি আইন অনুযায়ী যেকোনো প্রতিষ্ঠানের পর্ষদে পরিবর্তন আসতেই পারে। তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের না। তবে নতুন পরিচালক নিয়োগ দিতে আমাদের অনাপত্তি লাগে। খেলাপি কেউ পরিচালক হচ্ছেন কি না, আরও বেশ কিছু বিষয় দেখে অনাপত্তি দেওয়া হয়।’
যদিও চাপ দিয়ে এমডিদের পদত্যাগ রোধ করতে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নীতিমালা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে বলা হয়, চুক্তির মেয়াদপূর্তির আগেই কোনো এমডি পদত্যাগ করতে চাইলে এক মাস আগে চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না।
এসআইবিএলের এমডির পদত্যাগে এসব নিয়ম মানা হয়নি। সাত মাস আগে ব্যাংকটির এমডি হিসেবে যোগ দেওয়া শহীদ হোসেনের মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত।
বেসরকারি খাতের এসআইবিএলে বড় পরিবর্তন হয় গত সোমবার। ওই দিন রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে এক সভায় পরিবর্তন আনা হয়। একই প্রক্রিয়ায় গত জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংকেও পরিবর্তন আসে। দুই ব্যাংক পরিবর্তনের সময়ই ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম উপস্থিত ছিলেন। ইসলামী ব্যাংকের পরিবর্তন হয়েছিল হোটেল রেডিসনে। এবার হয় ওয়েস্টিনে।