চীনের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যকে দুঃখজনক বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এমন মন্তব্য আশা করে না বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারতসহ চারটি দেশের অনানুষ্ঠানিক নিরাপত্তা সংলাপ বা কোয়াডে গেলে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক খারাপ হওয়ার বিষয়ে চীনের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য বাংলাদেশকে অবাক করেছে। বাংলাদেশ বলেছে, ঢাকা এখন পর্যন্ত কোয়াডে যোগ দেওয়ার আগ্রহ না দেখালেও চীনের রাষ্ট্রদূত আগ বাড়িয়ে মন্তব্য করেছেন। দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া যখন ভালো, তখন এমন মন্তব্য কোন পরিপ্রেক্ষিতে করা হলো, তা বাংলাদেশ জানতে চায়।
গতকাল মঙ্গলবার সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, আজ বুধবার দিনের কোনো এক সময়ে চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এ নিয়ে কথা বলতে পারেন।
চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গত সোমবার ঢাকায় কূটনৈতিক সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বলেছিলেন, বাংলাদেশ কোয়াডে যোগ দিলে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হবে। এ নিয়ে দেশে–বিদেশের গণমাধ্যমে নানা পর্যায়ে আলোচনা চলছে।
অবশ্য চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বার্তা দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি। যদিও গতকাল সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নেপালের কাছে বাংলাদেশের ওষুধসহ জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী হস্তান্তর অনুষ্ঠানের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা কী করি না করি, সেটা সব সময় মিডিয়াকে বলি না। উই হ্যাভ ডিফারেন্ট ওয়ে অব ডুয়িং থিঙ্কস। আমরা জানি, আমরা কী করব। সবকিছু বলে দিলে তো মহামুশকিল।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কোয়াড থেকে এখনো বাংলাদেশকে যোগ দিতে কোনো অনুরোধ জানানো হয়নি। তাই চীনের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যকে আগ বাড়িয়ে বলা হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ‘এমনিতে চীন কখনো অন্যের বিষয়ে নাক গলায় না। আর এ রকম অ্যাগ্রেসিভ কখনো কাউকে বলতে শুনিনি। এটা খুবই দুঃখজনক। চীনের কাছ থেকে আমরা এ ব্যবহার আশা করিনি।’
সব মিলিয়ে কোয়াড ও আইপিএস ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার অভিন্ন অবস্থান যে বেইজিংকে ভাবিয়ে তুলেছে, তার প্রতিফলন ঘটেছে গত এপ্রিলে বাংলাদেশ সফরে আসা চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে।
তবে বাংলাদেশের কূটনীতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের আমলে দেশটির কূটনীতিকেরা আগ্রাসী কূটনীতি পন্থা অনুসরণ করছেন। গত সোমবার চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য সেটারই প্রতিফলন। বিশেষ করে কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন দেশে চীনের রাষ্ট্রদূতদের এমন আগ্রাসী ভঙ্গিতে দেখা যাচ্ছে। আর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে পশ্চিমের যে চাপে চীন আছে, তা কমানোর জন্য দেশটি এই পথে হাঁটছে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, করোনা মহামারির সময় চীন বিভিন্ন দেশে নিজের প্রভাব বাড়াচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও চীনের উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা আছে। যদিও ভারতের সঙ্গে গত বছরের সীমান্ত সংঘাত, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নৈকট্য, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস) আর সবশেষ মার্চে কোয়াডের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক চীনকে ভাবিয়ে তুলেছে।
অন্যদিকে গত এক বছরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রসচিব, সেনাপ্রধান, বিমানবাহিনীর প্রধানসহ সরকারের নানা পর্যায়ের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করেছেন। এই সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত, উপপরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ নানা পর্যায়ের প্রতিনিধিরাও বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের সফর চীনকে কিছুটা হলেও ভাবিয়ে তুলেছে। আর এই সময়ে চীনের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের মধ্যে শুধু গত মাসে ঢাকা ঘুরে গেছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী। মূলত চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওই সময় কোয়াড আর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের জোটের বিষয়ে বেইজিংয়ের অস্বস্তির বার্তা ঢাকাকে দিয়ে গেছেন।
শুধু কোয়াড নয়, গত সোমবার টিকা নিয়ে বাংলাদেশের পদক্ষেপেরও সমালোচনা করেছেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত। দুই দেশের সম্পর্কে দূরত্ব আর টানাপোড়েনের কিছু ঘটেছে কি না, জানতে চাইলে গতকাল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক এই প্রতিবেদককে বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক, তাতে দুই দেশের বোঝাপড়া এখন পর্যন্ত ভালো। এমন কিছু হয়নি যে তিনি এসব বলবেন। তবে চীনের টিকার অনুমতির বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতার যে দিকগুলো তিনি সামনে এনেছেন, তার সবটাই যে বাড়িয়ে বলেছেন, তা নয়। টিকার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণের অভিযোগের কিছুটা হলেও সত্যতা রয়েছে। তবে দুই পক্ষ যখন বোঝাপড়া করে সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে, তখন হুট করে চীনের রাষ্ট্রদূতের এমন বক্তব্য অবাক হওয়ার মতো।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত মার্চে কোয়াড শীর্ষ ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনের আগে ঢাকা সফর করেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সে সময় তিনি স্পষ্ট করে বলে গেছেন, বঙ্গোপসাগর ঘিরে সংযুক্তিতে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। এই সংযুক্তিতে তিনি জাপানের মতো দেশকে যুক্ত রাখার কথাও বলেছেন। আর জাপান বলেছে, কক্সবাজারের মাতারবাড়ী প্রকল্প আইপিএসের অংশ।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ২০১৬ সালে ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ওই সফরের সময় পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণ, যোগাযোগ অবকাঠামো, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিসহ নানা ধরনের উন্নয়নকাজে ২৭টি প্রকল্পে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চীন।
এর পরপরই ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আইপিএস, বঙ্গোপসাগর ঘিরে সংযুক্তির বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এমনকি মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় বঙ্গোপসাগর আর আইপিএসের বিষয়গুলো সামনে এনেছে জাপান। সব মিলিয়ে কোয়াড ও আইপিএস ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার অভিন্ন অবস্থান যে বেইজিংকে ভাবিয়ে তুলেছে, তার প্রতিফলন ঘটেছে গত এপ্রিলে বাংলাদেশ সফরে আসা চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে।
অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রতিরক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের নিবিড় সহযোগিতা রয়েছে। গত এক দশকে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকটি সফর এই সম্পর্কে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বেইজিং গেছেন। আর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ২০১৬ সালে ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ওই সফরের সময় পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণ, যোগাযোগ অবকাঠামো, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিসহ নানা ধরনের উন্নয়নকাজে ২৭টি প্রকল্পে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চীন।
বাংলাদেশ-চীন শীর্ষ নেতাদের ২০১৬ সালের ওই বৈঠক বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যথেষ্ট কৌতূহল তৈরি করে। ওই সফরের পরপর বাংলাদেশের কেনা চীনের সাবমেরিন সরবরাহের পর ভূরাজনীতিতে যোগ করে নতুন মাত্রা। এরপরই ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর ঢাকায় এসে দুই দেশের প্রতিরক্ষা চুক্তির খসড়া দিয়ে যান। পরের বছর ২০১৭ সালে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। ওই বছর থেকেই আইপিএসে যোগ দিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চীন তার দেশের অর্থনীতির বিকাশ নিয়ে পশ্চিমের চাপে আছে। আবার রাজনৈতিকভাবে হংকং, উইঘুর, তাইওয়ান আর দক্ষিণ চীন সাগর নিয়েও পশ্চিমারা দেশটিকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। তাই ইদানীং সবকিছুতে চীনকে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যাচ্ছে। অতীতে চীন নিজের অর্থনীতি বিকাশের সময় চুপ ছিল। ওই সময়ে দেশটি এগিয়েছেও ভালো। বেশি প্রতিক্রিয়া দেখালে বিপদ বাড়তে পারে।