সৌদি আরবে অবস্থানরত মুসল্লি ছাড়া নতুন করে অন্য দেশ থেকে কেউ হজ পালনে যেতে পারবেন না। সে কারণে অনেকে হয়তো আর কখনো হজ করার সুযোগ না-ও পেতে পারেন। তেমনি এ বছর হজকে ঘিরে যে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার কর্মকাণ্ড চলার কথা ছিল, তা-ও বন্ধ হয়ে গেল।
এই দুঃসময়ে সৌদিপ্রবাসী অর্ধলক্ষাধিক বাংলাদেশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ক্ষতি হবে বাংলাদেশ বিমানের। তারা এবার হজের যাত্রী বহন করে ১০০ কোটির টাকার বেশি লাভের আশা করছিল। কিন্তু সে আশাও গেছে।
আজ হজ নিয়ে সভা
সৌদি হজ মন্ত্রণালয়ের এ ঘোষণার পর বাংলাদেশ থেকে হজে যেতে নিবন্ধিত ব্যক্তিদের জমা দেওয়া টাকা ফেরত দেওয়া বা এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে আজ বুধবার সভা ডেকেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হজ এজেন্সির মালিকদের সংগঠন হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সভাটি হবে ভার্চ্যুয়াল।
আর্থিক ক্ষতি
মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হজ এজেন্সির মালিকদের সংগঠন হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) সূত্রে জানা গেছে, মহামারি পরিস্থিতির কারণে হজের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ায় দুই ধরনের ক্ষতি হলো। একদিকে শারীরিক অবস্থা বা মৃত্যুর কারণে অনেকে হয়তো আর কখনো হজ করার সুযোগ না-ও পেতে পারেন। অন্যদিকে এ বছর ৬৫ হাজার হাজিকে ঘিরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার কর্মকাণ্ড হতো। তা বন্ধ হয়ে গেল।
এ ছাড়া বাংলাদেশের হাজিদের নিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশি সেখানে যানবাহন, হোটেলসহ হজের নানা আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তাঁরাও আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
যাঁরা টাকা জমা দিয়েছেন
মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, হজ নিবন্ধনের জন্য যাঁরা টাকা জমা দিয়েছেন, তাঁদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে, নাকি আগামী বছরের জন্য রাখা হবে, তা সভায় আলোচনা করে ঠিক করা হবে। সভার সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানো হবে। কারণ, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহর আকস্মিক মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। তাঁর অনুমতি নিয়ে সিদ্ধান্ত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে।
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম শাহাদত হোসাইন তসলিম প্রথম আলোকে বলেন, হজে যাওয়ার জন্য নিবন্ধনকারীদের টাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকে জমা আছে। হজ এজেন্সির কাছে কোনো টাকা নেই। সুতরাং দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, কেউ যেতে না চাইলে টাকা ফেরত নেওয়া যাবে। তবে টাকা ফেরত নেওয়ার পর তাঁর নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। ফলে তিনি পরের বছরের জন্য নতুন করে নিবন্ধনের যোগ্যতা হারাবেন।
গত সোমবার সৌদি আরবের হজ মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, সৌদি আরবে বর্তমানে যাঁরা বসবাস করছেন, তাঁদের মধ্যে খুবই সীমিতসংখ্যক মুসল্লি এবারের পবিত্র হজে অংশ নিতে পারবেন। করোনাভাইরাস মহামারির হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে সারা বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সৌদি সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়। সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতাদের ফোরাম দ্য কাউন্সিল অব সিনিয়র স্কলার হাজিদের সংখ্যা সীমিত রাখার এই সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম।
এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশসহ বাইরের দেশের মুসল্লিরা এবার সৌদি আরবে গিয়ে পবিত্র হজ পালন করতে পারবেন না। বিশ্বব্যাপী মহামারি পরিস্থিতিতে এবারের পবিত্র হজব্রত পালন নিয়ে নিবন্ধিত হজযাত্রীরা উৎকণ্ঠা ও সংশয়ের মধ্যে ছিলেন। এর মধ্যেই ঘোষণাটি এল।
ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হজ এজেন্সিজ সূত্রে জানা গেছে, নির্ধারিত কোটা অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে এবার বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার মুসল্লির হজে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু এবার ৬৪ হাজার ৫৯৪ জন হজে যেতে আগ্রহী ছিলেন।
বিমানের শত কোটি টাকা লাভ হাতছাড়া
সোনার তরী আর অচিন পাখি নামে অত্যাধুনিক দুটি নতুন উড়োজাহাজ কিনে একেবারে আটঘাট বেঁধে নেমেছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। নতুন নতুন গন্তব্যে পাড়ি দেওয়ার পাশাপাশি এবার হজ ফ্লাইট পরিচালনা করে শত কোটি টাকা আয়ের পরিকল্পনা ছিল রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এই বিমান সংস্থার। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এবার কেউ হজে যেতে পারবেন না। তাই হজ ফ্লাইট থেকে বিমানের সেই আয়ের পথটি বন্ধ হয়ে গেল।
বাংলাদেশ থেকে ২০১৯ সালে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। বিমানের হজ ফ্লাইট ও শিডিউল ফ্লাইটে যান ৬৩ হাজার ৫৯৯ জন। বাকি অর্ধেক হজযাত্রী গিয়েছেন সৌদি এয়ারলাইনসে। দুই মাসব্যাপী হজ ফ্লাইট পরিচালনায় শিডিউল ফ্লাইটসহ মোট ৩৬৫টি ফ্লাইট পরিচালনা করে বিমান। এর মধ্যে ৩০৪ ‘ডেডিকেটেড’ এবং ৬১টি শিডিউল ফ্লাইট। ৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ‘প্রি-হজ’-এ মোট ১৮৯টি ফ্লাইট পরিচালনা করে, যার মধ্যে ডেডিকেটেড ১৫৭টি এবং শিডিউল ৩২টি। পোস্ট-হজে ১৪৭টি ফ্লাইট ছিল। এসব ফ্লাইট চালাতে বিমান বরাবরের মতো গত বছর দুটি উড়োজাহাজ ভাড়া করেছিল। গত বছর বিমানের কোনো হজ ফ্লাইট বাতিল হয়নি। প্রতিটি ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ে চলাচল করেছে।
চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার হজযাত্রীর সৌদি আরবে যাওয়ার কথা ছিল। তাই আশায় বুক বেঁধেছিল বিমান কর্তৃপক্ষ। আয়ের মাত্রাও দ্বিগুণ তোলার পরিকল্পনা করেছিল। প্রায় ৩০০ আসনের করে দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার কিনে বহরে যুক্ত করে বিমান। সে জন্য হজকেন্দ্রিক উড়োজাহাজ ভাড়ায় আনার পরিকল্পনা থেকে সরে যায়। সম্পূর্ণ নিজস্ব উড়োজাহাজে করে হজ ফ্লাইট শিডিউল সাজিয়েছে বিমান। কিন্তু করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সৌদি আরব এবার বাইরের দেশের হজযাত্রীদের সে দেশে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাই বাংলাদেশসহ বাইরের দেশের মুসল্লিরা এবার সৌদি আরবে গিয়ে পবিত্র হজ পালন করতে পারবেন না।
বিমানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিমান লাভ করেছিল ২১৮ কোটি টাকা। এর ২৫ শতাংশ মুনাফা আসে হজ ফ্লাইট পরিচালনা করে। হজ ফ্লাইট সামনে রেখে গত জানুয়ারি মাসে বিমানের পরিকল্পনা সাজানোর কাজ সম্পন্ন হয়। এর অংশ হিসেবে উড়োজাহাজ লিজ নেওয়া থেকে সরে আসে বিমান। কারণ, বিমানের নিজস্ব উড়োজাহাজ রয়েছে ১২টি। এর মধ্যে ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, ৬টি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ও ২টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ রয়েছে। আরও ছয়টি লিজে আনা উড়োজাহাজ রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৮টি এখন বিমানবহরে। এসব উড়োজাহাজের মধ্যে ছয়টি সুপরিসর উড়োজাহাজকে সর্বক্ষণিক হজ ফ্লাইটের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। তাই হজ ফ্লাইট থেকে ৩০০ কোটি টাকা আয়ের পথ এগিয়ে কমপক্ষে শত কোটি টাকা লাভের আশায় ছিল বিমান। হজ ফ্লাইটের মুনাফা দিয়ে করোনাভাইরাসের কারণে গত ছয় মাসের লোকসানের বোঝা কমানোর চেষ্টাও ছিল বিমানের। এখন নতুন করে হিসাব কষতে হচ্ছে বিমানকে।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ১ হাজার ২৭৯ কোটি টাকার আর্থিক চাপে পড়ে যায় বিমান। এরপর থেকে বিমানের প্রতি মাসে ক্ষতি হচ্ছে আড়াই শ কোটি টাকার বেশি। ক্ষতির ধাক্কা সামাল দিতে সরকারের কাছ থেকে এক হাজার কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা নিতে হয়েছে বিমানকে। তবে এপ্রিল মাস থেকে কিছু আয় করেছে তারা।
হজ ফ্লাইট বাতিলে বিমানের ক্ষতি বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মহিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিমানের প্রতি মাসে আড়াই শ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। হজ ফ্লাইট থেকে ৩০০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য ছিল এবার। এর মধ্য থেকে শত কোটি টাকা লাভ হতো। কিন্তু সেটি বন্ধ হয়ে গেল। তবে এপ্রিল থেকে চার্টার্ড ফ্লাইট দিয়ে কিছু আয় হচ্ছে। সামনের মাসে এই আয় আরও কিছুটা বাড়তে পারে বলে আশা করা যায়।