>• সাড়ে তিন বছরের চিত্র
• হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই শিশু, তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি।
• প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি সরকার।
গত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৫ হাজার ১২০ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২০ জন। এই সময়ে আহত হয়েছেন ৬২ হাজার ৪৮২ জন। এসব দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশ ঘটেছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও অতিরিক্ত গতির কারণে।
এসব সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই শিশু, তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। এই দুই শ্রেণিকে দেশের ভবিষ্যৎ ও অর্থনীতির মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।
এসব তথ্য বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই)। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে করণীয় সরকারের জানা। আগেও সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সরকারসংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির স্বার্থের কারণে এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সরকার অনেকটাই উদাসীন। সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজটে যে ক্ষতি হচ্ছে, সরকার তাকে জাতীয় সমস্যা মনে করে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মানসিকতা, দক্ষ জনবল কিছুই নেই। শুধু আইন পাস করলে সমস্যার সমাধান হবে না। পুরো প্রক্রিয়ায় বদল আনতে হবে।
দেশের ১০টি জাতীয় দৈনিক, ৬টি অনলাইন দৈনিক, ৬টি স্থানীয় দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল। তাতে দেখা যায়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮ হাজার ৭৩২টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা এবং নিহতের ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে সংঘটিত ৩৪ শতাংশ দুর্ঘটনার সঙ্গে মোটরসাইকেল সংশ্লিষ্ট ছিল। ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বাসের দুর্ঘটনা ২৫ শতাংশ। কার, মাইক্রোবাস ১৫ শতাংশ।
তবে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা আরেক সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই বাংলাদেশের (নিসচা) হিসাবে, গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৩ হাজার ৩৬৭ জন। আহত হয়েছেন ১৯ হাজার ১৫৮ জন।
বুয়েটের এআরআই দুর্ঘটনার কারণসংক্রান্ত পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে থাকে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। আর পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ১০ শতাংশ।
পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, দেশের সব মহানগরে যত পথচারী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, তার দ্বিগুণের বেশি মারা যান শুধু ঢাকা মহানগরে। অবশ্য ঢাকায় মানুষ ও যানবাহন দুটিই বেশি। এআরআইয়ের তথ্যমতে, পথচারীদের জন্য রাজধানীর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হচ্ছে ৫৪টি ব্যস্ত মোড়। চালকের বেপরোয়া মনোভাব, পথচারীদের অসচেতনতা ও সড়কের ত্রুটির কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এআরআইয়ের গবেষক ও বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৌশলগত ত্রুটি ও সচেতনতার অভাবে পথচারীরা মারা যাচ্ছেন। সব স্থানে জেব্রা ক্রসিং না থাকা, ফুটপাত না থাকা কিংবা অবৈধ দখলে চলে যাওয়া, স্বয়ংক্রিয় সংকেতব্যবস্থার অনুপস্থিতি, পথচারী পারাপারে অব্যবস্থাপনা অন্যতম প্রকৌশলগত ত্রুটি।
গবেষণা বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। এআরআইয়ের গবেষণা অনুসারে, দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া লোকজনের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহত লোকদের সাড়ে ১৮ শতাংশ শিশু, এদের বয়স ১৫ বছরের নিচে।
এআরআইয়ের গত বছরের এক গবেষণায় বলা হয়, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি ও দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্ট যানজট অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক নিরাপদ করতে যে ব্যয় করা হবে, সেগুলো বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে সড়ক নিরাপত্তায় বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে আর্থিক ক্ষতি কমবে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ আর্থিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে সবার আগে দরকার সঠিক তথ্য। কিন্তু সরকারের কাছে সঠিক তথ্যই নেই। নেই উদ্যোগও। সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে সরকারি তথ্যের উৎস পুলিশ। সড়ক দুর্ঘটনার পর মামলা হলেই পুলিশ তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে। ভুক্তভোগী কেউ মামলা না করলে কিংবা নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে ফেললে পুলিশের খাতায় কোনো তথ্য থাকে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত, ধরন ও কারণ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় পরিকল্পনা প্রণয়নে ঘাটতি থেকে যায়।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১৯৯৭ সাল থেকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা করে আসছে। এর মধ্যে সাতটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ পরিকল্পনায় ২০২৪ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা সড়ক দুর্ঘটনার যে হিসাব প্রকাশ করছে, তাতে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে পঞ্চম জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কৌশলগত কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, ২০১৬ সালের মধ্যে ১২-২০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা কমানো হবে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে করা কর্মপরিকল্পনায় সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে নয়টি পদক্ষেপ চিহ্নিত করা হয়েছে, যা আগেরগুলোতেও ছিল। কর্মপরিকল্পনায় থাকলেও এগুলোর বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। এই নয়টি পদক্ষেপের অধিকাংশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নয় দফা দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মেধাবী ও কর্মক্ষম জনসম্পদ হারিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। সরকার সঠিক কর্মসূচি গ্রহণ করলে এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনা ৯০ শতাংশ কমানো সম্ভব। তিনি মনে করেন, শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে।