‘আবুল মনসুর আহমদের সংবিধান চিন্তা: জুলাই অভ্যুত্থান ও সাংবিধানিক সংস্কার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অতিথিরা। মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে
‘আবুল মনসুর আহমদের সংবিধান চিন্তা: জুলাই অভ্যুত্থান ও সাংবিধানিক সংস্কার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অতিথিরা। মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে

আলোচনা সভায় বক্তারা

স্বৈরাচারী ব্যবস্থার সুযোগ না রেখে সংবিধান সংশোধন করতে হবে

স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার সুযোগ না রেখে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এই অধিকার রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা রাখতে হবে সংবিধানে। বর্তমান সংবিধান জনগণের ইচ্ছাকে ধারণ করে না। সংবিধান হতে হবে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক। সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে কেউ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন।

‘আবুল মনসুর আহমদের সংবিধান চিন্তা: জুলাই অভ্যুত্থান ও সাংবিধানিক সংস্কার’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ।

সভায় সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। অসুস্থতার কারণে কথা বলেননি তিনি। তাঁর পক্ষে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান। ড. কামালের বক্তব্যে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অধিকার নিয়ে সংবিধান রচনা করা হয়। যেখানে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়, বৈষম্য নিরসন আর ধর্মনিরপেক্ষতায়। এবারের আন্দোলন আবার বৈষম্য নিরসনের বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। একই সঙ্গে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার কোনো সুযোগ যাতে না থাকে, সেই আলোকে সংবিধানের সংশোধনীর সুপারিশ তৈরি করতে হবে।

প্রবীণ এই রাজনীতিক বলেন, আবুল মনসুর আহমদ সংবিধানকে গতিশীল পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করেছেন, যা সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের দাবি রাখে। শিক্ষার্থী ও নাগরিকের ওপর ঘটে যাওয়া গণহত্যা ও দমন–পীড়ন এবং আইনের শাসনের প্রতি যে অবজ্ঞা দেখা গেছে, সেসব অবশ্যই সংবিধানে স্থান পাওয়া উচিত বলে মনে করেন ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, সংবিধানকে এমনভাবে সংশোধন ও চর্চা করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না হয়, যাতে কোনো নাগরিকের সঙ্গে অন্যায়, অবিচার আবার না ঘটে। এটাই হবে সংবিধানের সত্যিকারের পরীক্ষা।

ড. কামাল হোসেন আরও বলেন, সাম্প্রতিক বিপ্লবের মূলে ছিল গণতন্ত্রের অভাব। সংবিধানে গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, মৌলিক অধিকারের ক্ষুণ্নতা একটি জাতিকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে এবং এই অধিকারগুলো রক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আরিফ খান। প্রবন্ধে বর্তমান সংবিধান বাতিল নয়, সংশোধনের পক্ষে মত দেওয়া হয়। সংবিধান সংস্কার করে কেউ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুবারের বেশি থাকতে পারবেন না, ৭০ অনুচ্ছেদের পরিশোধন, ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান পূর্ণরূপে কার্যকর করা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর অর্পণ, বিচারপতি নিয়োগ আইন প্রণয়ন, ’৭২-এর সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা, নির্বাচন কমিশনের বাজেট সম্পূর্ণরূপে কমিশনের অধীন ন্যস্ত করা, নির্বাচনের সময়ে প্রশাসনের কর্তাদের বদলির ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে অর্পণ করা, সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য স্থায়ী কলেজিয়াম ঘোষণা করা, নির্বাচনের প্রার্থীদের খরচ সরকারি ফান্ড থেকে নির্বাহের বিধান করা প্রভৃতি বিষয়ে সংস্কারের দাবি জানানো হয়।

প্রয়াত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের সন্তান ও দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বপ্ন কেন ধরে রাখা যায় না? এ ক্ষেত্রে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর। তারা অনেক আদর্শের কথা বলে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তাদের রূপ পাল্টে যায়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে গেছে জনগণকে খুশি করার জন্য বক্তব্য আর ক্ষমতায় গেলে দলীয় স্বার্থে দেশ চালানো।

অসৎ নীতি, জনগণকে ধোঁকা দেওয়া, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে এড়িয়ে চলা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উল্লেখ করে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে জনগণের মতপ্রকাশের জন্য নির্বাচন। ভোট যারা বেশি পাবে, তারা সরকার গঠন করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গঠিত সরকারের বিরাট দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচনে পরাজিতদের জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে দেখা।

বিদ্যমান সংবিধানে এমন কিছু আছে, যা সরকারকে স্বৈরাচার করে তুলছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা। তিনি বলেন, সংবিধান জনপ্রতিনিধিত্বমূলক হতে হবে, যেখানে আদিবাসীদের বলা হবে না—‘তুমি বাঙালি হয়ে যাও’। আপাতত একটা সংক্ষিপ্ত সংবিধান রচনা করা এবং সময় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচনা করার প্রস্তাব দেন তিনি।

সংবিধান বাতিল নয়, সংস্কারের পক্ষে মত দেন সেন্টার ফর পার্লামেন্টারি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জালাল ফিরোজ। বিদ্যমান সংবিধান ভালো হলে গত বিতর্কিত তিনটি নির্বাচন ঠেকানো গেল না কেন, সেই প্রশ্ন রাখেন লেখক সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, এই সংবিধান জনগণের ইচ্ছাকে ধারণ করে না। তাই এখান থেকে যে অংশ বাদ দেওয়া দরকার, তা বাদ দিতে হবে।

নতুন সংবিধান হলেও বিতর্ক চলবে বলে মনে করেন লেখক জাহেদ উর রহমান। তিনি বলেন, সংবিধানের কোন কোন জায়গায় সমস্যা রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধন, যা-ই করা হোক না কেন, দিনশেষে সংবিধান ঠিকমতো কাজ করছে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদের আহ্বায়ক ইমরান মাহফুজ।