>
শিল্প-সাহিত্য, সাংবাদিকতা, শিক্ষা ও গবেষণায় আলো ছড়িয়েছেন তাঁরা। এবার মিলল স্বীকৃতি। একুশে পদক পেলেন চার গুণীজন প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন, শিশুসাহিত্যিক সুকুমার বড়ুয়া, বংশীবাদক ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম এবং কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। পেশাগত কারণে সুকুমার বড়ুয়াকে ঢাকায় অবস্থান করতে হলেও বাকি তিনজন চট্টগ্রামেই থাকেন। তাঁদের নিয়ে আজকের আয়োজন। লিখেছেন ওমর কায়সার
আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন
শিক্ষায় অবদান রাখার জন্য এ বছর একুশে পদক পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। তাঁর জন্ম ১৯৩৭ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়া জেলার কাঞ্চনা গ্রামে। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষা ও গবেষণায় নিয়োজিত আছেন তিনি। ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর (এমএ) শেষ করেন। ১৯৬৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। ১৯৬৭ সালে লিংকনস ইন থেকে নেন ব্যারিস্টার এট ল ডিগ্রি।
সত্তরের দশক থেকে চট্টগ্রামে বসবাস করছেন তিনি। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ১৯৭৪ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন। বর্তমানে তিনি ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস, আইন ও মানবাধিকার, মুসলিম সমাজ ও নারী বিষয়ে এ পর্যন্ত পাঁচটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। এর মধ্যে তিনটি বই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর।
একুশে পদকপ্রাপ্তির পর তাঁর অনুভূতি সম্পর্কে বলেন, ‘এটাই শুধু বলব, একুশে পদক মহান একুশের ভাষাশহীদদের অতুলনীয় আত্মত্যাগ, বাঙালি জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির বিমূর্ত প্রকাশ। স্বভাবতই এ পদক পেয়ে আমি উদ্বেলিত ও গর্বিত।’
সুকুমার বড়ুয়া
ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একুশে পদক পেয়েছেন সুকুমার বড়ুয়া। তাঁর অনেকগুলো ছড়ার বইয়ের মধ্যে একটির নাম ‘কোয়াল খাইয়ে’। এটি চট্টগ্রামের ভাষায় লেখা একটি অসাধারণ ছড়ার বই। এই বই দিয়েই সুকুমার বড়ুয়া চট্টগ্রামের ভাষাকে যেন বাঁচিয়ে রাখলেন। সেটি চাটগাঁভাষীর জন্য আনন্দের বিষয় হলেও ১৯৩৮ সালে রাউজানের বিনাজুরি গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এই মানুষটির সবচেয়ে বড় অবদান বাংলা শিশুসাহিত্যে। বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্য মানেই অনিবার্যভাবে প্রথমেই উঠে আসে তাঁর নাম। আমাদের ছড়াসাহিত্য তাঁকে ছাড়া কল্পনা করা যায় না। পাগলা ঘোড়া, ভিজে বেড়াল, ঠুসঠাস, চন্দনা রঞ্জনার ছড়া, এলোপাতাড়ি, নানা রঙের দিন, চিচিং ফাঁক, কিছু না কিছু, নদীর খেলা, আরও আছে, এ রকম শব্দের জাদু লাগানো ছন্দের চমক ভর্তি তাঁর ছড়ার বইগুলো।
একুশে পদক পাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘খুশি হয়েছি। ছড়া লিখে লিখে কম পুরস্কার তো পেলাম না। পুরস্কার পেলে সব মানুষের খুশি লাগে। এই পুরস্কার তো আমি অনেক আগেই পেতে পারতাম। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হচ্ছে একটা ছড়া লেখার পর তাৎক্ষণিক যে আনন্দ পাওয়া যায় সেটি।’
ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম
শুদ্ধ সংগীতে অবদান রাখার জন্য একুশে পদক পেয়েছেন ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম। ১৯৪৫ সালে বাবার কর্মস্থল রাজবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর গ্রামের বাড়ি সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর স্মৃতিধন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। কিন্তু তাঁর বেড়ে ওঠা এবং স্থায়ী বসবাস চট্টগ্রামে। বাঁশি বাজিয়ে উপমহাদেশের অনেক সংগীতবোদ্ধার মন কাড়লেও কণ্ঠসংগীতেই হাতেখড়ি হয়। ওস্তাদ বেলায়েত আলী খাঁর শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন। তাঁর কাছে শিখতে শিখতেই মেরিন একাডেমির প্রথম ব্যাচে ভর্তি হয়ে গেলেন। শুরু হলো সমুদ্র–জীবন। চারপাশের অঢেল জলরাশির মধ্যে দিনরাত পড়ে থাকলেও সুরের হাতছানি ভোলেননি। ছুটি নিয়ে সমুদ্র থেকে ডাঙায় এসেই শুরু করতেন সুরের সাধনা। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে নাবিকের জীবন থেকে পুরোপুরি অবসর নিয়ে শুরু করলেন সুরের জীবন। ভারত ও বাংলাদেশের অনেক গুণী শিল্পীর কাছ থেকে তালিম নিলেন ধ্রুপদ সংগীতে। এর মধ্যে ভারতের পান্নালাল ঘোষ, দেবেন্দ্র মুদ্রেশ্বরও ছিলেন। এরপর ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাঁশি বাজিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন তিনি। একুশে পদক পাওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বহু বছর পর যন্ত্রসংগীতে এ রকম একটা পুরস্কার এল। এই পুরস্কার আমার স্পৃহা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি এখনো রেওয়াজ করি প্রতিদিন। আমার খুব ভালো লাগছে। স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া তো কিছু হয় না। এই পুরস্কার পাওয়ার পর আমাদের ভাইবোন সবাই খুব খুশি। সবচেয়ে বড় কথা, আমার মা এটা দেখে যেতে পারছেন। তাঁর বয়স এখন ৯২ বছর। একজন সন্তানের এই অর্জন মায়ের জন্য কত খুশির, সেটা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন!’
আবুল মোমেন
গত বছর প্রবন্ধে বাংলা একাডেমি পুরস্কার জেতার পর এই বছর একুশে পদক পেলেন কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, কলামসহ এ পর্যন্ত প্রায় ৩০টি বই বেরিয়েছে তাঁর। আবুল মোমেনের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর। কথাসাহিত্যিক আবুল ফজলের সন্তান আবুল মোমেন সাংবাদিকতা শুরু করেছেন ১৯৭৬ সালে। শুরুর দিকে কাজ করেছেন রেডিওতে। প্রিন্ট মিডিয়ায় তাঁর সাংবাদিকতা শুরু হয় ডেইলি লাইফ পত্রিকায়। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। জীবনভর সামরিক শাসন, ধর্মীয় উগ্রতা, মৌলবাদ, অপশাসন ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কলাম লিখেছেন। রাজনীতিসহ সমসাময়িক বিষয়ে সব সময় সরব তিনি। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। এর নজির ছড়িয়ে আছে পূর্বকোণ, ভোরের কাগজ আর প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায়। তাঁর সর্বশেষ কর্মক্ষেত্র ছিল প্রথম আলো। এই পত্রিকায় তাঁর কলাম জনপ্রিয়ও হয়েছে। আবুল মোমেন বর্তমানে দৈনিক সুপ্রভাত–এর উপদেষ্টা সম্পাদক।
একুশে পদক পাওয়ার অনুভূতি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘খুশি লাগছে। তবে কাঁধের ওপর দায়ও এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে, আরও অনেক কিছু করতে হবে। স্বীকৃতি সব সময় দায়িত্ব বাড়ায়। লেখালেখির পাশাপাশি আমাকে তো অনেক কাজ করতে হয়। শিশুশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ফুলকি গড়ে তুলেছি। সেই প্রতিষ্ঠানের পেছনে চার দশক লেগে আছি। লেগে থাকলেই কাজ হয়। শিশুশিক্ষায় গঠনমূলক ও সৃজনশীল কাজের জন্য ফুলকি আজ সারা দেশে পরিচিত। তেমনি সাংবাদিকতায় চার দশক ধরে কাজ করেছি। আমার মনে হয়, যেকোনো পেশায় থেকে জাতির জন্য, সমাজের জন্য অবদান রাখার সুযোগ থাকে। একজন কৃষকও জাতীয় উৎপাদনে ভূমিকা রাখেন। সাংবাদিকতায় সেই কাজ আরও ভালোভাবে করা যায়। আমি সেই কথাটা সব সময় মনে রাখি। সেই দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি পেলাম।’