তানভীর হত্যা মামলা

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া আসামি ভ্রমর জামিন পেয়েই লাপাত্তা

তানভীর হত্যা মামলা
তানভীর হত্যা মামলা

নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া আসামি সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর জামিনে মুক্ত হওয়ার পর থেকে লাপাত্তা।
জানা গেছে, হাইকোর্টের দুই বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে ১৩ মার্চ ভ্রমরের জামিন আবেদনের শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালত ভ্রমরের ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। আদালতের আদেশনামায় স্বাক্ষর করা হয় ১৮ মার্চ। খুবই দ্রুততার সঙ্গে আদালতের জামিন আদেশনামার কপি নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে পৌঁছানো হয়। ২০ মার্চ বিকেল চারটায় কারাগার থেকে বেরিয়ে যান ভ্রমর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারাগারের এক কর্মকর্তা ভ্রমরের বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কারাগারের আশপাশের লোকজন এই প্রতিবেদককে জানান, কারাগার থেকে বেরিয়ে একটি মোটরসাইকেলের পেছনে উঠে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড ধরে ঢাকার দিকে গেছেন ভ্রমর।
গত শুক্রবার বেলা আড়াইটায় শহরের ২১ নম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দী সড়কের (চেম্বার রোড) বাটা ভবনে ভ্রমরের বাসায় গিয়ে খোঁজ করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরিবারের সদস্যরা জানান, জামিনে বেরিয়ে ভ্রমর বাসায় আসেননি।
ত্বকী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের পর ভ্রমর গত ১২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম এম এম মহিউদ্দিনের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের শহরের কলেজ রোডে অবস্থিত উইনার ফ্যাশন নামের টর্চার সেলে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ রাতে ত্বকীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আজমেরীর নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ডে কালাম, লিটন, রাজীব, মামুন, কাজল, শিপন, জ্যাকি ও লিটন অংশ নেয়। পরে আজমেরীর ড্রাইভার জামশেদ ও অন্যরা টয়োটা এক্স ফিল্ডার প্রাইভেট কারের পেছনে ত্বকীর লাশ তুলে চারার গোপ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়। হত্যাকাণ্ড ও লাশ নদীতে ফেলার পুরো কার্যক্রমেই ভ্রমর উপস্থিত ছিলেন বলে আদালতকে জানান। তিনি আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তাঁর মা মেহের নিগার মিতা জেলা জাতীয় মহিলা পার্টির সাবেক সভানেত্রী এবং সাংসদ নাসিম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, শিগগিরই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে। র‌্যাবের সূত্র আরও জানায়, তদন্তে ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বেই ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে ভ্রমরের নাম থাকার কথাও সাংবাদিকদের জানায় র‌্যাব।
র‌্যাবের তদন্তে জানা গেছে, মূলত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব হওয়ায় এবং পরিবহন চাঁদাবাজির প্রতিবাদে নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলায় রফিউর রাব্বির প্রতি চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয় ওসমান পরিবার। মূলত রফিউর রাব্বিকে শায়েস্তা করতেই তাঁর নিরপরাধ মেধাবী কিশোর সন্তানকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়। মামলায় ভ্রমরই একমাত্র আসামি যিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামি সালেহ রহমান ওরফে সীমান্তকে গত বছরের জুন মাসে হাইকোর্ট জামিন দিয়েছিলেন। জামিননামার আদেশের কপি জেলা কারাগারে পৌঁছার আগেই অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগে উপস্থিত হয়ে জামিন বাতিলের আবেদন জানালে তা মঞ্জুর হয়।
ভ্রমরের মুক্তি পেয়ে লাপাত্তা হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা দেখছি রাষ্ট্র ও সরকার ত্বকী হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে আগ্রহী নয়। তাই এই বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। হত্যাকারীদের এমপি পদ দিয়ে উল্টো পুরস্কৃত করা হয়েছে।’
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী মনে করেন, এ ঘটনার পেছনে প্রভাশালী কোনো মহল কলকাঠি নাড়ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘শুনেছি জামিন পাওয়ার পর ভ্রমর দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কয়েক দিন পর দেখা যাবে, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ক্যাঙ্গারু পারভেজ গুমের মতো ভ্রমর গুমের মামলায়ও আমার আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হবে।’
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, আইনি বিধান না থাকলেও প্রচলিত নিয়ম আছে চাঞ্চল্যকর কোনো মামলার আসামিকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হলে সরকারি পিপি বা কোর্ট ইন্সপেক্টরের মাধ্যমে পুলিশকে জানানো হয়। কিন্ত ভ্রমরের বিষয়টি জানানো হয়েছে তাঁর মুক্তি পাওয়ার অনেক পরে। তিনি বলেন, ‘রাত ১১টার দিকে আদালত পুলিশের পরিদর্শক আমাকে ফোনে জানান, ত্বকী হত্যা মামলার আসামি ভ্রমরকে কারাগার থেকে বিকেলে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।’ জেলা কারাগার থেকেও তাঁকে ফোনে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ফলে সে সময় তাঁদের কিছুই করার ছিল না।