একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, যিনি নিজেকে সাহসী, কার্যকর এবং অত্যন্ত দক্ষ অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁর মানহানি করতে সরকার জনগণের অর্থ ব্যয় করছে (এটি করার অধিকার কি আছে?)—এমনটা অবশ্য সচরাচর ঘটে না। এটি মূলত তাঁর কাজের মাধ্যমে বহু দুর্নীতির ঘটনা উন্মোচিত হয়েছিল বলেই। তাঁর সব প্রতিবেদনেই বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক নথি, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অভিযোগের চিঠি ও আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত সংস্থার অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। এসব প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিবেকবান কর্মকর্তারা বিশাল দুর্নীতির বিষয়ে তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করে এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন।
কোটি কোটি টাকার এসব দুর্নীতির তদন্তের ক্ষেত্রে যে তেমন কিছুই হয়নি, তাতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। এতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ওই সব দুর্নীতিবাজের বদলে যে সাংবাদিক তাঁদের দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ করেছিলেন, তিনিই আজ কারাগারে আছেন। আমরা আশা করছি, আজকে তিনি জামিন পাবেন।
গতকাল বুধবার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল যে রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্যসচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে অন্যায়ভাবে প্রবেশ করেছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর মুঠোফোনে সরকারি কাগজপত্রের ছবি তুলেছিলেন এবং কিছু নথি ‘চুরি’ করারও চেষ্টা করেছিলেন।
এ অভিযোগের ভিত্তিতে রোজিনাকে একান্ত সচিবের কক্ষে আনুমানিক বেলা তিনটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল। এ সময়ে তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানি করা হয়। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁকে অবমাননাকর ও অপমানসূচক কথাবার্তা বলেন।
বিজ্ঞাপনে প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি বিষয় উত্থাপন করা দরকার, যা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. রোজিনা ইসলামকে একান্ত সচিবের কক্ষে এত দীর্ঘ একটা সময়, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেন জোর করে রাখা হয়েছিল? এ ঘটনা কাউকে অন্যায়ভাবে আটকে রাখার শামিল, যা গুরুতর অপরাধ। এটি একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের বিষয় এবং আইন অনুযায়ী এটি শাস্তিযোগ্য।
২. কোন কর্তৃপক্ষের অধীনে রোজিনার দেহ তল্লাশি করা হয়েছিল? দেহ তল্লাশি শুধু অনুমোদিত ব্যক্তি কর্তৃক যথাযথ পর্যবেক্ষণ এবং নির্ধারিত নিয়মের মধ্যে হতে হয়। আমরা যত দূর জেনেছি, মন্ত্রণালয়ের একজন নিম্নপদস্থ নারী কর্মচারী রোজিনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর দেহ তল্লাশি করেছিলেন। এটি স্পষ্টতই তাঁর জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর অভিজ্ঞতা ছিল। যদি কোনো অপরিচিত ব্যক্তি কারও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করেন, তবে তা যেকারও জন্যই অবমাননাকর। ব্যক্তিমর্যাদার অধিকারী যেকোনো মানুষ এ পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করবেন।
৩. টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, একজন নারী হাত দিয়ে রোজিনার গলার ঠিক নিচে, বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে আছেন। এই ভঙ্গিমা বেশ ভীতিপ্রদর্শনমূলক।
৪. রোজিনার সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলা হয়েছিল, তার পুরোপুরিই ছিল অপমানজনক। শুরু থেকেই তাঁকে এমন একজন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছিল, যাঁর ‘অপরাধ’ প্রমাণিত এবং একজন অপরাধীর সঙ্গে যেমন আচরণ করা হয়, তা–ই হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে।
৫. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘...এতে প্রতীয়মান হয় যে...(এতে প্রমাণিত হয় যে তিনি রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরি করেছিলেন।)’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনে কোনো প্রমাণ ছাড়াই তাঁকে ‘চোর’ বলা হয়েছে, যা পুরোপুরি মানহানিকর।
৬. ওই বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘...রোজিনা ইসলাম মাটিতে শুয়ে পড়লে তাকে উঠিয়ে চেয়ারে বসানোর চেষ্টা করা হয়।’ এটি স্পষ্ট যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁকে হয়রানি করতে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে তাঁরা তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির বিষয়ে এবং সাহায্যের জন্য বারবার আবেদনে মনোযোগ দেননি। রোজিনা হঠাৎ মাটিতে শুয়ে পড়বেন কেন? কারণ, তিনি অসুস্থবোধ করছিলেন এবং তিনি বারবার চিকিৎসাসহায়তা চাইছিলেন, যা তাঁকে দেওয়া হয়নি।
৭. বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘তার মোবাইল ফোনটি চেয়ে নেওয়া হয় এবং তিনি সেটার পাসওয়ার্ড খুলে দেন।’ প্রশ্ন হলো, কোন কর্তৃত্বের অধীনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মী তাঁর মোবাইল ফোন নিয়ে নিয়েছিলেন? শুধু পুলিশ এটি করতে পারে। মুঠোফোন একটি ব্যক্তিগত জিনিস। এতে অনেক কিছুই থাকে, যেসব পুরোপুরি ব্যক্তিগত। আইনত কোনো কর্তৃপক্ষ ছাড়া কারও মুঠোফোন নিয়ে নেওয়া তাঁর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর আক্রমণ, যা একটি অপরাধ।
রোজিনার কাছ থেকে মুঠোফোন নেওয়ার পর তাতে যে ছবি ও ফাইলের অনুলিপি যুক্ত করা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্ন এখন সংগত কারণেই উঠেছে।
ওপরের এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর বিজ্ঞাপনটিতে নেই।
বরং একটি গল্প বানিয়ে জনগণের টাকা ব্যয় করা হয়েছে শুধু একজন সম্মানিত সাংবাদিককে অবমাননা করতে। যাঁদের সত্য প্রকাশ করার কথা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তিন সদস্যের সেই তদন্ত কমিটি নিয়েও অবশ্যই প্রশ্ন তুলতে হবে। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওই বিজ্ঞাপন প্রকাশের মাধ্যমে রোজিনাকে পরিষ্কারভাবে ‘চোর’ বলে অভিযুক্ত করেছে। তাই ওই তদন্ত কমটি যে কতটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে এবং কী ‘সত্য’ উন্মোচন করবে, তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় নিজস্ব কমিটির কাজকে প্রহসনে পরিণত করেছে এবং জনগণের টাকা নষ্ট করার আরও একটি উদাহরণ তৈরি করেছে।
সাংবাদিকেরা দাবি করেছেন, তদন্ত কমিটি এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠন করতে হবে, যাঁরা নিরপেক্ষ থাকবেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আমলাদের দিয়ে নয়, যাঁদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে রোজিনা প্রতিবেদন করেছিলেন। তাঁদের এ দাবি অবশ্যই যৌক্তিক।
আইনমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা আমাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আশ্বাস দিয়েছেন। রোজিনার জামিনের মধ্য দিয়ে আমরা এর শুরুটা দেখতে চাই।
আমরা কেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপন ছেপেছি, এ নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। এটি প্রকাশ করা না হলে এমন একটি সেন্সরশিপ তৈরি করা হতো, যা আমরা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করি। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আমরা মনে করি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিভঙ্গি জানার অধিকার জনগণের আছে।
(দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত মন্তব্য প্রতিবেদন থেকে অনূদিত)
মাহ্ফুজ আনাম : সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার