বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাতে লক্ষ্য পূরণে এসএমসির জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী এবং খাওয়ার স্যালাইন বড় ভূমিকা রাখছে।
সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি বা এসএমসি সাড়ে চার দশক ধরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাতে নিবিড়ভাবে যুক্ত। সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের এই যুক্ততা জন্মনিয়ন্ত্রণ, পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে মানুষের অভ্যাস ও আচরণে পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তন দেশের স্বাস্থ্যের অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে।
১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে ‘ফ্যামিলি প্লানিং সোশ্যাল মার্কেটিং প্রজেক্ট’ হিসেবে এসএমসির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯০ সালে এটি একটি অলাভজনক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়ায়। ২০১২ সাল থেকে এসএমসি নিজের আয়ে চলার মতো সক্ষমতা দেখায়। ২০১৪ সালে এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড নামে পৃথক লাভজনক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। অলাভজনক ও লাভজনক কর্মকাণ্ডের এক জটিল ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছে এসএমসি। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত বোর্ড অব ডিরেক্টরস এটি পরিচালনা করে। বোর্ডের সদস্যরা বিনা পারিশ্রমিকে সেখানে সময় ও বুদ্ধি–পরামর্শ দেন।
জনসংখ্যা খাতে সরকারের সবচেয়ে বড় অংশীদার এসএমসি। বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাতে লক্ষ্য পূরণে এসএমসির জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী এবং খাওয়ার স্যালাইন বড় ভূমিকা রাখছে।
তিনটি বড় কারখানায় এসএমসির পণ্য উৎপাদিত হয়। এসব পণ্য সারা দেশে বিতরণ ও বিপণনের জন্য শক্তিশালী চ্যানেল আছে এসএমসির। এই চ্যানেলের মাধ্যমে ১ লাখ ১৫ হাজার ওষুধের দোকান, ১ লাখ ৭০ হাজার মুদিদোকান এবং ৫০টি বড় এনজিওর কাছে এসএমসির পণ্য পৌঁছে যায়। অগ্রাধিকার পাওয়া ২০টি জেলার ৯৩টি উপজেলায় প্রায় দুই হাজার ৭০০ নারী উদ্যোক্তা এসএমসির পণ্য বিক্রি করেন। এদের বলা হয় ‘গোল্ডস্টার মেম্বার’। সারা দেশে আছেন আট হাজার ‘ব্লু স্টার’ সদস্য। তাঁরা নির্দিষ্ট এলাকায় মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি সেবাকেন্দ্রে যেতে মানুষকে সহায়তা করেন। আর আছে ৫০০ ‘পিংক স্টার’ সদস্য। তাঁরা মূলত ডিগ্রিধারী চিকিৎসক। এসব চিকিৎসক আইইউডি বা ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহারে সহায়তা করেন।
এসএমসির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তছলিম উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পণ্য বিতরণ ও সেবা দেওয়ার একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আছে এসএমসির। নেটওয়ার্কের সদস্য বা কর্মীরা মানুষের কাছে স্বাস্থ্য বা জনসংখ্যা বার্তা পৌঁছে দেন। মানুষ সচেতন হয়, মানুষের মধ্যে চাহিদা তৈরি হয়। ওই একই কর্মীরা তখন মানুষের কাছে স্বল্প মূল্যে এসএমসির জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী বা জনস্বাস্থ্য পণ্য বিক্রি করেন। সেখান থেকে তাঁরা একটা লাভ পান।’
সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (২০১৭–১৮) তথ্য বলছে, দেশের ৩৮ শতাংশ সক্ষম দম্পতি এসএমসির জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহার করে। কনডম ব্যবহারকারীদের ৬২ শতাংশ এসএমসির কনডম ব্যবহার করে। বাজারের এখন এসএমসির ১৩ ধরনের কনডম আছে। এসএমসির কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব কনডমের দাম দরিদ্র শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে।
জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য বাজারে এখন মুখে খাওয়ার নানা ধরনের বড়ি আছে। ওই একই জরিপ বলছে, নারীরা যত বড়ি খান তার ৪৭ শতাংশ সরবরাহ করে এসএমসি। বাজারে এসএমসির আটটি ব্র্যান্ডের বড়ি পাওয়া যায়। এ ছাড়া ইনজেক্টেবল জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ৩৩ শতাংশ আসে এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।
পণ্য বিতরণ ও সেবা দেওয়ার একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আছে এসএমসির। তারা মানুষের কাছে স্বাস্থ্য বা জনসংখ্যা বার্তা পৌঁছে দেয়। মানুষ সচেতন হয়, মানুষের মধ্যে চাহিদা তৈরি হয়।তছলিম উদ্দিন খান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসএমসি
দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর প্রচার–প্রচারণার শুরু মূলত রাজা কনডম এবং মায়া বড়ির মাধ্যমে। একসময় এসব সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ানোর জন্য স্লোগান ছিল: ‘বুদ্ধিমান হউন, ঠিক কাজটি করুন’। রাজা–মায়ার প্রচারণার সঙ্গে এই ধরনের স্লোগান মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছিল। দেশের মানুষ ঠিক কাজটি করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ব্যবহার বেড়েছে, নারীপ্রতি সন্তান জন্মদানের হার কমেছে।
খাওয়ার স্যালাইন মানে এসএমসির ওরস্যালাইন
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে সারা দেশে এসএমসির উৎপাদিত খাওয়ার স্যালাইন বিক্রি হয়েছিল ১০৪ কোটি প্যাকেট। এর পরিমাণ ছিল সারা দেশে বিক্রি হওয়া খাওয়ার স্যালাইনের প্যাকেটের ৫৫ শতাংশ।
ডায়রিয়া, বিশেষ করে শিশুদের ডায়রিয়া চিকিৎসায় খাওয়ার স্যালাইনের বড় ভূমিকা আছে। এই স্যালাইন ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে দেশে পাঁচ বছর বা তার কম বয়সী শিশুর মৃত্যু কমেছে, শিশুদের রোগগ্রস্ততাও কমেছে।
সারা দেশের ছোট–বড় সব ওষুধের দোকানে ওরস্যালাইন পাওয়া যায়। এ ছাড়া পাড়ার মুদিদোকানে, দুর্গম চর বা পাহাড়ি এলাকায় ওরস্যালাইন পাওয়া যায়। ওরস্যালাইন ব্যবহার বাংলাদেশের মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অনেক পরিবার বা ব্যক্তিকে দু–এক প্যাকেট ওরস্যালাইন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মতো বাড়িতে রাখতে দেখা যায়। অনেকে ভ্রমণের সময় তা সঙ্গে রাখেন। ওরস্যালাইনের সাফল্য এসএমসিকে আরও জনস্বাস্থ্য পণ্য তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে। অণুপুষ্টিকণাসমৃদ্ধ মনিমিক্স বড় বাজার পেয়েছে।
তুলনামূলকভাবে কম মূল্যে নারীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন বাজারে এনেছে এসএমসি। এসএমসির জয়া স্যানিটারি ন্যাপকিন এখন দেশে বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া সহজে ও দ্রুত গর্ভধারণ পরীক্ষার জন্য তাদের আছে ‘কুইক টেস্ট’।
কনডম, বড়ি, ওরস্যালাইন, পানীয়, মনিমিক্সসহ সব মিলে বাজারে এসএমসির পণ্য আছে মোট ৩৬টি।
৫০ বছর আগে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যাপারে খোলামেলাভাবে কথা বলার পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না। সে রকম একটি পরিবেশে এসএমসি মানুষের অভ্যাস ও আচরণ পরিবর্তনে কাজ শুরু করেছিল। বিভিন্ন ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও সামগ্রী নিয়ে তারা রাষ্ট্রীয় বেতার, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রে প্রচার–প্রচারণা শুরু করেছিল। তারা সারা দেশে বিলবোর্ড, ব্যানার–ফেস্টুন ব্যবহার করেছে। দেয়াল, ভবন বা পানির ট্যাংকে নানা ধরনের তথ্য ও বার্তা লিখে দিয়েছে। একই কাজে তারা রিকশার পেছনে ও বাজারের ব্যাগে ছবি এঁকেছে। নৌকার পালে দেখা গিয়েছিল রাজা কনডমের লোগো।
সাধারণ মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এসএমসির ছিল ভ্রাম্যমাণ চলচ্চিত্র কর্মসূচি। এই কর্মসূচির মাধ্যমে শত শত গ্রামীণ হাটবাজারের অডিও ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে মানুষকে তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি এসএমসির পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো। অনেকে মনে করেন, এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক বিপণন কর্মসূচি।
সময়ের বিবর্তনে কাজের ধরনে পরিবর্তন এনেছে এসএমসি। নতুন নতুন সেবার পাশাপাশি নতুন নতুন পণ্য তারা বাজারে আনছে। কিছু পণ্য বিক্রি করে যে মুনাফা হচ্ছে, তা ব্যবহৃত হচ্ছে অলাভজনক স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে। এসএমসির দর্শন অলাভজনক সেবা।