একের পর এক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি প্রকাশ হয়ে পড়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একে অপরকে দায়ী করছে। সাইনবোর্ডসর্বস্ব হাসপাতাল ও বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে করোনা চিকিৎসা ও নমুনা পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হলেও এর দায় কেউ নিচ্ছে না। অথচ এ অনিয়মের শিকার হয়ে ভুগছেন সাধারণ মানুষ। জেকেজির পর রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অদক্ষতা ও ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করেছে।
গতকাল রোববার জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ও সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগে ৬ জুলাই করোনা চিকিৎসার নামে প্রতারণার ঘটনায় রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালা করে দেয় র্যাব। এই হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমকে খুঁজছে পুলিশ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, সাহেদের দেশ ছাড়ার সুযোগ নেই।
এদিকে গতকাল পাঁচ প্রতিষ্ঠানের করোনাভাইরাস পরীক্ষার অনুমোদন বাতিল করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে কেয়ার মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, সাহাবুদ্দীন মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, স্টেমজ হেলথ কেয়ার, থাইরোকেয়ার ডায়াগনস্টিক এবং চট্টগ্রামের এপিক হেলথ কেয়ার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেছেন, এই হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে কোভিড-১৯ আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কাজই শুরু করতে পারেনি।
অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলায় ডুবে আছে দেশের স্বাস্থ্য খাত। লাইসেন্সবিহীন রিজেন্ট হাসপাতালের অপকর্ম প্রকাশ হওয়ার পর প্রশ্ন ওঠে, করোনা চিকিৎসার মতো স্পর্শকাতর দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে দেওয়া হলো। এর দায় কার। গত শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেয়। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই ব্যাখ্যায় ক্ষুব্ধ হয়েছে মন্ত্রণালয়। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে এ জন্য কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে কী বোঝানো হয়েছে এবং রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে কী কী বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর মন্ত্রণালয়ের কোনো নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ নেই। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান হলেও এর অবস্থান দূরে, মহাখালীতে। অধিদপ্তর কী চুক্তি করছে, কার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে, কী কাজ করছে, সেটা দেখতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গিয়ে বসে থাকেন না। তাই সেখানে হওয়া অনিয়মের দায় সেখানকার লোকজনকেই নিতে হবে। মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল অনুবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার কোনো নির্দেশনা বা সম্মতিপত্র মন্ত্রণালয় দেয়নি।
>ডিজির বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়েছে মন্ত্রণালয়। একের পর এক অনিয়মের শিকার হয়ে ভুগছেন সাধারণ মানুষ।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয়কে দায়ী করে এ ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে শোকজ (কারণ দর্শানো) করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘এ ধরনের ব্যাখ্যার বিষয়ে তিনি আমাদের কিছুই জানাননি। তাঁরা বাঁচার জন্য তাৎক্ষণিক এ চিঠি দিয়েছেন।’ রিজেন্ট হাসপাতালের বিষয়ে সচিব বলেন, ‘মন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কিছুই জানে না। মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত করা হয়নি, মন্ত্রণালয়ে কোনো চিঠিও দেওয়া হয়নি।’
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা চেয়েছে, আমি অবশ্যই জবাব দেব। কেউই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নন। আমি তো আমার পরিচালককে অবশ্যই বিশ্বাস করব। আমি কোনো ভুল করিনি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সবকিছু চিঠিপত্র দিয়ে হয় না। মৌখিক নির্দেশেও অনেক কিছু হয়। তারপরও বলছি, আমার কাছে প্রমাণ আছে। আমি সেটা দেব।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) আমিনুল হাসান মহাপরিচালককে যে নথি (ফাইল নোট) দিয়েছেন, সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে কে নির্দেশ দিয়েছেন। এই নোট উপমহাপরিচালক (এডিজি) হয়ে মহাপরিচালকের কাছে যায়। এরপর যখন সমঝোতা স্মারকে সই করা হয়, তখন কারা উপস্থিত ছিলেন, সেই ছবিও রয়েছে। শুধু অধিদপ্তর চুক্তি করেছে, মন্ত্রণালয় কিছু করেনি, এটা ঠিক নয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কিছু পদক্ষেপ নিয়ে আগেও বিভ্রান্তি ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। গত ২৫ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, ‘যদি কোনো রোগীর কোভিড-১৯-এর লক্ষণ থাকে, তবে প্রথমে চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দেবেন এবং প্রয়োজনে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) পরিধানকৃত দ্বিতীয় চিকিৎসকের কাছে প্রেরণ করবেন এবং তিনি পিপিই পরিহিত অবস্থায় রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করবেন।’ পরে সমালোচনার মুখে আদেশটি স্থগিত করা হয়।
একই দিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে কেউ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হলে সেনাবাহিনীর তল্লাশিচৌকি বা থানার ওসিকে জানানোর কথা বলা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন গণপদত্যাগের হুমকি দেয়। সমালোচনার মুখে সেই আদেশও বাতিল করা হয়। তখনই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি সামনে চলে আসে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন সচিব আসাদুল ইসলাম তখন বলেছিলেন, আদেশটি তাঁকে না জানিয়ে করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের এই সমন্বয়হীনতা সেই প্রথম থেকে। তারা যেভাবে একে অপরের মুখোমুখি হয়ে ‘ব্লেইম গেম’ খেলছে, তাতে করে ‘টিমওয়ার্ক’ থাকল না, ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। তিনি বলেন, ‘আমি তো মনে করি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোনো বড় কাজই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া করতে পারবে না। করা সম্ভব নয়। তবে এখনো জনস্বার্থে তারা সমন্বয় করে কাজ করতে পারে, সেই সুযোগ আছে।’