জীবিত মানুষকে ‘মৃত’ দেখিয়ে বিধবা ভাতার টাকা তোলা হচ্ছে। জনপ্রতিনিধি ও সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তিন বছর ধরে এভাবে ভাতা তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার নারান্দিয়া ইউনিয়নে জীবিত হয়েও মৃত এমন ১৩ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে।
এই ১৩ ব্যক্তি হলেন ভাতাভোগী জাওয়ানী গ্রামের নুরজাহানের স্বামী এখলাছ উদ্দিন, কুলসুমার স্বামী হাছেন আলী, যবেদার স্বামী আলী নেওয়াজ, রুমেলার স্বামী জহর উদ্দিন, হালেমার স্বামী হাসিম উদ্দিন, আছিয়ার স্বামী আবদুর রহিম, রানু বেগমের স্বামী সিদ্দিক খান, মাহমুদার স্বামী মরম আলী, হাজেরা আক্তারের স্বামী ইসলাম উদ্দিন, জমিলার স্বামী বজলুর, ফিরোজার স্বামী রইছ উদ্দিন, ভুগী গ্রামের জুলেখার স্বামী নবী হোসেন ও নাছিমার স্বামী আবু হোসেন। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে তাঁদের মৃত দেখিয়ে স্ত্রীদের নামে বিধবা ভাতা তোলা হচ্ছে।
নারান্দিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম খান এবং সমাজসেবা কার্যালয়ের যোগসাজশে এ কাজ হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে গত ২৬ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কাছে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করতে সোমবার (গতকাল) সমাজসেবা কর্মকর্তা ও ইউএনওকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রমাণিত হলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
লিখিত অভিযোগ, স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১০টি উপজেলায় ১৯ হাজার ৯৭৪ জন বিধবা ভাতাভোগী রয়েছেন। এর মধ্যে পূর্বধলায় ৪ হাজার ৫৪৩ জন। তাঁদের মধ্যে নারান্দিয়া ইউনিয়নে ৩৭৮ জন বিধবা ভাতা পান। আর ওই ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫০। এই ৫০ জনের মধ্যে দুটি গ্রামে ১৩ নারীর স্বামী জীবিত রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের মৃত দেখিয়ে স্ত্রীরা দীর্ঘদিন ধরে ভাতা তুলছেন।
এ নিয়ে এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা ও ভাতাভোগীদের মধ্যে নুরজাহান, যবেদা, রানু বেগম, হাজেরা ও নাছিমা এবং তাঁদের স্বামীদের সঙ্গে কথা হলে ভাতা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, ওয়ার্ড সদস্য আবুল কালাম খান ভুল বুঝিয়ে তাঁদের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কার্ড করে দিয়েছেন। তাঁদের বলা হয়েছিল, দরিদ্র ভাতার জন্য সরকার কার্ড চালু করেছে। এ জন্য অবশ্য আবুল কালামকে কিছু টাকাও দিয়েছেন তাঁরা।
বিষয়টি তদন্ত করতে সোমবার (গতকাল) সমাজসেবা কর্মকর্তা ও ইউএনওকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রমাণিত হলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।কাজী মো. আবদুর রহমান, জেলা প্রশাসক, নেত্রকোনা
সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিধবা ভাতা পেতে শুধু ভাতাভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি লাগে। আর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ‘স্বামী মৃত’ কথাটি উল্লেখ করে রেজল্যুশন পাঠান উপজেলা বিধবা ভাতা বাস্তবায়ন কমিটিতে। সেখান থেকে পাস হলে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। সেই হিসাবের মাধ্যমে টাকা পান ভাতাভোগীরা।
হাজেরার স্বামী ইসলাম উদ্দিন বলেন, ‘আমি এই লজ্জা কই রাহি! আমারে মরা মানুষ বানাইয়া রাখছে আমার বউ আর মেম্বর মিল্লা। অহন জমি বেচাকেনা করলেও তো সমস্যায় পড়তে হইবো।’ রানু বেগমের স্বামী সিদ্দিক মিয়া বলেন, ‘আমি আগে জানতাম না। মেম্বর কইছে, আমার স্ত্রীর ভোটার আইডি কার্ড ও ছবি নিয়া একটা সরকারি ভাতার কার্ড কইরা দিব। পরে কিছু খরচপাতি দিয়া এই কার্ড করছি। অহন বিষয়ডা জাইন্না শরম লাগে।’
জানতে চাইলে অভিযুক্ত আবুল কালাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি অনেক আগের ঘটনা। যখন চেয়ারম্যান বাইচ্চা আছিলেন, তখন। অনেকের স্বামী ছাইড়া অন্য জায়গায় বিয়া কইরা গেছে গা। সমাজসেবার লোকজনই এসব খুঁইজ্জা বাইর কইরা কার্ড কইরা দিছে। কার্ডে আমার তো কোনো সিগনেচার (স্বাক্ষর) নাই। আর আমি এই কাজ করছি না।’
নারান্দিয়া ইউপির চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ তালুকদার কয়েক মাস আগে মারা যান। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. খোকন মিয়া এ ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আলাল উদ্দিন বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।