কাচু আলুটারি গ্রামটির অনেক মানুষ এখনো অন্যত্র রাত কাটান। দিনের বেলায় স্বাভাবিক কাজকর্ম করলেও রাত হলেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ে। গতকাল মঙ্গলবার ওই গ্রাম ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া যায়।
গ্রামের লোকজন জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যাওয়া অন্তত পাঁচজন এখনো বাড়ি ফেরেননি। আবার পুলিশ কোনো মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তারও দেখায়নি।
রংপুর শহরের উপকণ্ঠের এই গ্রামে ৩ অক্টোবর জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই গ্রামে দুই একর জমি চুক্তিতে নিয়ে ঘাসের খামার করেছিলেন কুনিও।
কাচু আলুটারি গ্রামে প্রায় দেড় হাজার পরিবারের বাস। হত্যাকাণ্ডের পর ভয়ে ওই গ্রামের কিছু পুরুষ গ্রাম ছাড়েন। গত এক সপ্তাহে অধিকাংশই বাড়িতে ফিরলেও ভয় কাটেনি। দিনে তাঁরা নিয়মিত কাজ করছেন, কিন্তু রাতে অনেকেই অন্য গ্রামে চলে যান।
গ্রামবাসী জানান, হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এবং গণমাধ্যমকর্মীরা গ্রামে এসে লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। নিভৃত গ্রামটিতে হঠাৎ এত তৎপরতায় ভয় পেয়ে অনেকেই গ্রাম ছাড়েন। গ্রামবাসী জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত গ্রামের পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ধরে নেয়। এঁদের চারজনকেই ছেড়ে দেওয়া হয়। শুধু আবদুর রশিদ (৩৫) নামের এক কৃষককে সাদা পোশাকের পুলিশ ১০ দিন আগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেলেও তাঁকে ছাড়া হয়নি বলে জানান তাঁর স্ত্রী মল্লিকা বেগম।
মল্লিকা গতকাল বলেন, ‘খেতোত (খেত) কাম করত ওমরা (স্বামী)। প্রতিদিনকার কাজ করিয়া যা আয় হয় তা দিয়া ভাত জুটত। এলা ছাওয়া দুইটাক নিয়া খুব কষ্টোত আছো।’
এদিকে পুলিশ রিমান্ডে থাকা কুনিওর ব্যবসায়িক সহযোগী হুমায়ুন কবির হিরার মা হাসিনা বেগম গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের দিনই হুমায়ুনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। আর সপ্তাহ খানেক আগে হুমায়ুনের স্ত্রী সুলাতানা আকতারকেও জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের পুলিশ। সেই থেকে সুলতানার খোঁজ নেই। হত্যাকাণ্ডের দিনই হুমায়ুনের সঙ্গে তাঁর আরেক ভাই তিতাসকেও ধরে নেওয়া হয়। তিতাসকে এখন অন্য একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার পর থেকে হুমায়ুনের আরেক ভাই কামরুলও নিখোঁজ বলে জানান তিনি।
কাউনিয়া থানার পুলিশ জানায়, কুনিও হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত দুজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আসামি করা হয়েছে। এই দুজনের মধ্যে কুনিওর ব্যবসায়িক সহযোগী হুমায়ুন ৫ অক্টোবর থেকে ১০ দিনের রিমান্ডে ছিলেন। ১৪ অক্টোবর পুনরায় আবেদন করে দ্বিতীয়বারের মতো পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরপর তাঁকে অন্য একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গত সোমবার সন্ধ্যার পর কোতোয়ালি থানার পুলিশ তৃতীয়বারের মতো রিমান্ডে নিয়েছে। অপরজন রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী খান ওরফে বিপ্লবকেও ৫ অক্টোবর ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হলেও ১০ অক্টোবর তাঁর রিমান্ড বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হয়।
অন্যদিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের হেফাজতে থাকা কুনিওর বাড়িওয়ালা গোলাম জাকারিয়া ওরফে বালা, তাঁর স্ত্রী আয়েশা জাকারিয়া, কুনিওকে বহনকারী রিকশার চালক মুন্নাফ আলীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হলেও তাঁরা ফেরেননি বলে এলাকাবাসী জানান। তবে যে বাড়ির সামনে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল, ওই বাড়ির মালিকের ছেলে মুরাদ হোসেনকে গত রোববার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঘটনার ১৭ দিন পরেও পুলিশ হত্যাকাণ্ডের স্থানটি পাহারা দিয়ে সংরক্ষণ করছে। পুলিশ সদস্যদের গতকাল দুপুরেও ঘটনাস্থলটি ঘিরে থাকতে দেখা যায়। ওই মেঠোপথে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। মানুষ সড়কের নিচে ধানখেতের ধার ঘেঁষে হেঁটে যাতায়াত করছে।