>
- ‘ও’ লেভেল পড়েছেন ভারতের দার্জিলিংয়ে
- ‘এ’ লেভেল রাজধানীর স্কলাসটিকা থেকে
- যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল শহরের নর্থ অ্যাম্ব্রিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর
- বগুড়ায় এসে করেছেন মাছ আর গরুর খামার।
পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি মাধ্যমে। ‘ও’ লেভেল পড়েছেন ভারতের দার্জিলিংয়ে, ‘এ’ লেভেল রাজধানীর স্কলাসটিকা থেকে। ব্রিটিশ স্কুল অব ল থেকে আইনে স্নাতক করেছেন। যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল শহরের নর্থ অ্যাম্ব্রিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা বিষয়েও নিয়েছেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।
তারপর? বগুড়ায় এসে করেছেন মাছ আর গরুর খামার। শুরুটা মাছ দিয়ে। সফলতাও পেয়েছেন। এরপর দেড় লাখ টাকায় দুটি বাছুর কিনে শুরু করেন গরুর খামার। এখন খামারে বিদেশি জাতের গরু আছে ৪৮টি। এসব গরুর দাম প্রায় ৬০ লাখ টাকা। গত কোরবানির ঈদে খামারের গরু বিক্রি করে লাভ করেছেন প্রায় দেড় কোটি টাকা।
এই তরুণ উদ্যোক্তার নাম রাহাতুল খান ওরফে রাহাত খান। বাড়ি বগুড়া সদর উপজেলার ধাওয়াকোলা গ্রামে। সচ্ছল বাবার আলাদা ব্যবসা আছে। কিন্তু সেদিকে পা বাড়াননি রাহাত। সব করছেন নিজের মতো করে।
চণ্ডীহারায় প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে রাহাতের আর কে অ্যাগ্রো ফার্ম লিমিটেড। দেড় বিঘা জমিতে গড়েছেন গরুর শেড। দেড় বিঘায় চাষ হচ্ছে বিদেশি ঘাস। খামারে রয়েছে শাহিওয়াল, ব্রাহমা, ফ্রিজিয়ান, সিন্ধি, জার্শি, রাজস্থানি ও ক্যাংরেজ জাতের গরু। ৩৭ বিঘা জমিতে আটটি পুকুরে চাষ হচ্ছে মাছের। ৮ থেকে ১০ কেজি ওজনের রুই-কাতলা-মৃগেল আছে পুকুরে। খামারে সারা বছর গড়ে ২০ জন মানুষ কাজ করেন। এর মধ্যে বেতনভুক্ত শ্রমিক ১২ জন।
গত বুধবার কথা হয় ধাওয়াকোলা গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা শামিম হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাহাত খানের কর্মযজ্ঞে অনুপ্রাণিত হয়ে গরুর খামার করেছি। গরুকে কখন কী খাবার দিতে হবে, সমস্যা হলে কী ওষুধ খাওয়াতে হবে, প্রয়োজনীয় সব পরামর্শ রাহাতই দিচ্ছেন।’
গ্রামের জিল্লুর রহমান বললেন, ‘রাহাত হামাকেরে যুবক চেংরাগুলার চোখ খুলে দিচে। বিদেশ থ্যাকে লেকাপড়া করে অ্যাসে গই গাঁওত গরুর খামারত কাম করিচ্চে। পুকুরত মাছ চাষ করিচ্চে। তাঁর এসব কাম দেকে এলাকার সগলি গরুর খামার করিচ্চে।’ আসলাম হোসেন বললেন, ‘রাহাত চেংরাডা বেকার পোলাপানেগরক বাড়িত থ্যাকে ডাকে লিয়ে য্যায়া খামারত গরু পোষা শিকাচ্চে।’
রাহাত খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মা-বাবার স্বপ্ন ছিল, লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পড়ে এসে আইন পেশায় যোগ দেই। এ জন্য ১৯৯৩ সালে ভারতের দার্জিলিং সেন্টপলে ভর্তি করিয়ে দেন। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল অ্যাম্ব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আইন এবং ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আলাদাভাবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করি। বিদেশে দেখেছি, সবাই নিজের কাজ নিজে করে। কোনো কাজকেই তাঁরা ছোট মনে করেন না। সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশে ফিরে চাকরির পেছনে না ছুটে নিজের গ্রামে স্বাধীনভাবে কিছু একটা করব।’
২০১৩ সালে দেশে ফেরেন রাহাত। কিছুদিন বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করেছেন। ব্যবসায় মন বসে না। আবার চাকরিতে তো মেধাবুদ্ধি অন্যের জন্য খাটাতে হয়! বললেন, ২০১৪ সালে নিজেদের পুকুরেই মাছ চাষ শুরু করলাম। ইন্টারনেট ঘেঁটে উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষের নানা তথ্য সংগ্রহ করলাম। ভালো ফলও পেলাম। স্বল্প সময়ে পুকুরে দেশীয় খাবার প্রয়োগ করেই বড় আকারের মাছ উৎপাদন হতে থাকল। এসব মাছের ছবি ফেসবুক ও অনলাইনে দিতাম। খামার থেকেই মাছ বিক্রি শুরু হলো।’
রাহাত খান বলেন, বগুড়া অঞ্চলে বড় মাছের বেশ কদর। সে কারণে পুকুরে দেশীয় প্রজাতির বড় মাছ চাষ করছি। লাভও অনেক বেশি। এসব মাছের ছবি অনলাইনে দিই। এরপর পাইকারেরা খামারে এসে পুকুর থেকে মাছ তুলে নেন। এখনো খামারে ১০ থেকে ২০ কেজি ওজনের রুই-কাতলা আছে।
গরুর খামার কেন করলেন—জানতে চাইলে রাহাত খান বলেন, ‘২০১৫ সালের দিকে মহাস্থান হাটে বিশাল একটা নাদুসনুদুস গরু জবাই হলো। শখ করে মাংস কিনলাম। কিন্তু রান্নার পর খালি চর্বি, স্বাদ নেই। বুঝলাম, অল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় অসৎ উপায়ে মোটাতাজা করা হয় গরুটিকে। কয়েক দিন আশপাশের খামারে গিয়ে বুঝলাম, উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই স্বশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত। ফলে হরমোনজাতীয় ওষুধ বা রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করে গরু মোটাতাজা করা যে মানবস্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। সিদ্ধান্ত নিলাম গরুর খামার করব। ২০১৬ সালে দেড় লাখ টাকায় দুটি এঁড়ে বাছুর কিনে শুরু করলাম। শুধু ঘাস, ভুসি, খৈল খাইয়ে এক বছর পর বিক্রি করে ভালো লাভ পেলাম। ২০১৭ সালে দেড় বিঘা জমির ওপর শেড তৈরি করলাম। পেছনে একখণ্ড জমিতে বিদেশি ঘাসের চাষ শুরু করলাম। খামারে গরুর সংখ্যা বাড়তে থাকল। গত কোরবানির ঈদে খামার থেকেই ৫০টি গরু বিক্রি করেছি। এসব গরুর বাজারমূল্য ছিল এক লাখ থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত।’
খামারে পাঁচজন শ্রমিক থাকলেও রাহাত প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থেকে গরুর দেখভাল করেন। গরুর কোনো সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের প্রয়োজন পড়ে না, ইন্টারনেট ঘেঁটে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেন।
রাহাতের স্ত্রী রুমাইয়া তাসনিম ব্যারিস্টার। তিনি হাইকোর্টে আইন পেশায় যুক্ত। ‘খামার করি, শুরুতে পরিবারের অনেকেই এটা মন থেকে চাননি। এখন স্ত্রীই সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেন, সহযোগিতা করেন’—বললেন রাহাত।
খামারের ব্যবস্থাপক ষাটোর্ধ্ব মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ‘দুই যুগ ধরে রাহাতের বাবার ইটভাটার ব্যবস্থাপক আচলাম। চেংরাডা (রাহাত) যখন খামারের দায়িত্ব লিবার কচলো তখন না করতে পারিনি। এটা রাহাতের খামার নয়; হামার নিজের খামার—সেই দরদ দিয়েই কাজ করি। পরিবার নিয়ে খামারেই থাকি।’
পরিচর্যার সুবিধার্থেই গরুর আলাদা নাম রাখতে হয়েছে বলে জানান রাহাত। ফ্রিজিয়ান জাতের একটি গরুর নাম রাখা হয়েছে পালোয়ান। আরেকটির নাম মহারাজ। খামারে আছে বাহাদুর, যুবরাজ, সুলতান, ডন নামের গরু। রাহাত জানান, শিগগিরই আরও অর্ধশত গরু খামারে আসবে।
মূলত কোরবানির ঈদে খামারের গরু বিক্রি করেন রাহাত। তবে গরু হাটে তুলতে হয় না। রাহাত খান বলেন, ‘বিক্রয় ডটকমসহ জনপ্রিয় অনলাইন কেনাকাটার সাইটে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গরুর ছবি দেই। অনলাইনে গরু পছন্দ করার পর খামারে এসে ক্রেতারা গরু কিনে নিয়ে যান।’
মাংস উৎপাদন ছাড়াও দুধ উৎপাদনের জন্য ইতিমধ্যেই কয়েকটি গাভি কিনেছেন। এ ছাড়া দেশি গরুর সঙ্গে সংকরায়ণ করে ব্রাহমার মতো বিদেশি উন্নত জাতের গরু প্রজননের জন্য তিনি প্রজননকেন্দ্রও গড়ে তুলেছেন।
এ খামার থেকে মাংস প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিদেশি রপ্তানির স্বপ্ন দেখছেন রাহাত খান। তিনি বলেন, দেশীয় পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যসম্মত মাংস প্রক্রিয়াকরণ এবং রপ্তানি করে বিশ্ববাজারে দেশের নাম জুড়ে দিতে চান তিনি। সে জন্য মাংস প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন রাহাত।