ধানের শীষ প্রতীকে ৫ বছর আগে ইউপি ভোটে বিএনপি জয়ের হার ৮.৯৪%। এবার স্বতন্ত্র হয়ে বিএনপির নেতাদের জয়ের হার ৯.৩৯%।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এবার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চলমান নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নিচ্ছে না। তবে দলটির স্থানীয় নেতাদের অনেকেই চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন করলেও ভোটের ফলে গতবারের (পাঁচ বছর আগে) চেয়ে ভালো করছেন বিএনপির নেতারা।
২০১৬ সালে দেশে প্রথমবারের মতো ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ছয় ধাপে মোট ৪ হাজার ১০৪টি ইউপিতে ভোট হয়। এর মধ্যে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি জয় পেয়েছিল ৩৬৭টি ইউপিতে। অর্থাৎ বিএনপি জয় পেয়েছিল ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ ইউপিতে।
অন্যদিকে এবার এখন পর্যন্ত ছয় ধাপে ৩ হাজার ৯৬৭টি ইউপিতে ভোট হয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের তথ্য অনুযায়ী, বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন ৩৩৮টি ইউপিতে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত ৩৬৮টি ইউপিতে বিএনপির নেতারা কতটিতে জয় পেয়েছিলেন, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। সে হিসাবে ৩ হাজার ৫৯৯টি ইউপিতে এবার ধানের শীষ প্রতীক ছাড়াই বিএনপির নেতাদের জয়ের হার ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। প্রতীক ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সমর্থন ছাড়া এবং নানা চাপের মধ্যে নির্বাচন করেও এমন ফলকে চমক বলে উল্লেখ করেছেন বিএনপির জেলা–উপজেলা পর্যায়ের একাধিক নেতা।
সপ্তম ধাপে ৭ ফেব্রুয়ারি আরও ১৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোট হবে। এই ধাপেও বিএনপির অনেক নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বগুড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বলেন, কোনো কোনো ইউপিতে ক্ষমতাসীন দলের কোন্দল, বিভেদ ও বিদ্রোহী প্রার্থী থাকার সুযোগে নৌকার বাইরে কেউ কেউ জয় পেয়েছেন। এর সঙ্গে বিএনপির দলীয় কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এটা প্রার্থীদের ব্যক্তিগত বিষয়। এর সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই।
২০১৪ সালে একতরফা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিএনপি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তবে ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বাধার মুখে অনেক জায়গায় বিএনপির মনোনীত প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে আন্দোলনের সময় মামলার আসামি হয়ে বিএনপির অনেকে ছিলেন পলাতক। সেবার অনেক জায়গায় বিএনপি প্রার্থী দেওয়ার মতো কাউকে খুঁজে পায়নি। সব মিলে ৫৫৪টি ইউনিয়নে বিএনপির কোনো প্রার্থী ছিল না।
আর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও পরে ইউপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। তবে গত বছরের ২ নভেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ঠাকুরগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ইউপি নির্বাচনে যদি দলের কেউ স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিতে চান, সেখানে কোনো বাধা থাকবে না। এটা দলীয় সিদ্ধান্ত।
জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন—সব নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনদের প্রধান সমস্যা ধানের শীষ।আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য
এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ছয় ধাপের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দ্বিতীয় ধাপে ৮৪০টির ইউপির মধ্যে ৬৪টিতে, তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ইউপির মধ্যে ৯১টিতে, চতুর্থ ধাপে ৮৩৬টির মধ্যে ৭৫টিতে, পঞ্চম ধাপে ৭০৭টির মধ্যে ৮৩টিতে এবং ষষ্ঠ ধাপে ২১৬টির মধ্যে ২৫টি বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয় পেয়েছেন।
বিএনপির নেতারা যেসব জেলায় ভোটে ভালো করেছেন, তার মধ্যে দিনাজপুর অন্যতম। এই জেলায় ছয় ধাপে ৯৪টি ইউপিতে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে ২৭টিতে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপির নেতারা। অর্থাৎ এই জেলার প্রায় ২৯ শতাংশ ইউপিতে বিএনপির নেতারা জয়ী হয়েছেন। দলটির স্থানীয় নেতারা বলছেন, সঠিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারলে, সরকারদলীয় নেতা–কর্মীদের বাধার মুখে না পড়লে ফল আরও ভালো হতো।
ষষ্ঠ ধাপের নির্বাচনে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আনিসুর রহমান। তিনি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারদলীয় সমর্থকদের বেপরোয়া ভাব, হুমকি–ধমকির পরও জনগণ তাঁকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো সভা–সমাবেশ করতে পারেননি। রাত আটটার মধ্যেই বাড়ি ঢুকতে হয়েছে। ভোটারদের ভয়–ভীতি দেখানো হয়েছে।
দিনাজপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বখতিয়ার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে কাউকে বাধা দেয়নি, তাই কেউ কেউ প্রার্থী হয়েছেন। দিনাজপুরে যে কয়টি ইউপিতে বিএনপির সমর্থকেরা জয় পেয়েছেন, এটা তাঁদের ব্যক্তিগত অর্জন। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এবং বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিলে ৯৫ শতাংশ ইউনিয়নে দলের প্রার্থীরা জয় পেতেন বলে তিনি দাবি করেন।
মানিকগঞ্জে ৬৫টি ইউপিতে ভোট হয়েছে। তবে সব জায়গায় বিএনপির নেতারা প্রার্থী হননি। এখানকার ১০টি ইউপিতে বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয় পেয়েছেন। নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা বলছেন, প্রচারণায় বাধা ও হামলা-মামলার মধ্য দিয়ে তাঁদের নির্বাচনী লড়াইয়ে মাঠে থাকতে হয়েছে। দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিলে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলে ফল অনেক ভালো হতো।
মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শত বাধাবিপত্তির পরও বিএনপির অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে তৃণমূলে বিএনপির বিপুল সমর্থক ও ভোটার রয়েছেন।
বগুড়ায় বিএনপির শক্ত অবস্থান আছে বলে বিবেচনা করা হয়। এই জেলায় মোট ১০৬টি ইউপিতে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির ৩২ জন নেতা চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ জিতেছে ৪০টিতে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ ১৫টিতে, জামায়াতের নেতারা ৬টিতে এবং অন্যান্য প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ১৩টি ইউপিতে।
বগুড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কোনো ইউপিতে ক্ষমতাসীন দলের কোন্দল, বিভেদ ও বিদ্রোহী প্রার্থী থাকার সুযোগে নৌকার বাইরে কেউ কেউ জয় পেয়েছেন। এর সঙ্গে বিএনপির দলীয় কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এটা প্রার্থীদের ব্যক্তিগত বিষয়। এর সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। যেহেতু বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তাই কে কতটা ইউপিতে জয়লাভ করল, তা নিয়ে দলের কোনো আগ্রহ নেই।
ইসি সচিবালয় জানায়, ষষ্ঠ ধাপে গত সোমবার দেশের ২১৬টি ইউপিতে নির্বাচন হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে ১১৭টিতে। স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় পেয়েছেন ৯৫টিতে। এর বাইরে জাতীয় পার্টি (জাপা) ৩টিতে ও জাতীয় পার্টি (জেপি) ১টি ইউপিতে জয়ী হয়েছে।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ষষ্ঠ ধাপে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ৩৯ জন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, আর ২৫ জন বিএনপির নেতা। এই ধাপে বিএনপি নেতারা ভালো ফল করেছেন বগুড়ায়। এখানকার ২৩টি ইউপির মধ্যে ১৩টিতেই বিএনপির নেতারা জয়ী হয়েছেন। এর বাইরে রংপুর, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা ভালো ফল করেছেন।
সে হিসাবে আওয়ামী লীগ এই ধাপে জয় পেয়েছে ৫৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ইউপিতে। এর আগে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগের জয়ের হার কমতে দেখা গিয়েছিল। তবে ষষ্ঠ ধাপে এসে তাদের জয়ের হার বেড়েছে। এই ধাপে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে ৫৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ইউপিতে। এর আগে পঞ্চম ধাপে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছিল ৪৯ দশমিক ২৭ শতাংশ ইউপিতে।
এবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি মাঠে না থাকলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জয়ের হার আগের তুলনায় কমেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছয় ধাপে মোট ২ হাজার ১৩৩টিতে জয় পেয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ২৬৯, দ্বিতীয় ধাপে ৪৮৫, তৃতীয় ধাপে ৫২৫, চতুর্থ ধাপে ৩৯৬, পঞ্চম ধাপে ৩৪১ ও ষষ্ঠ ধাপে ১১৭টিতে জয় পায়। ছয় ধাপ মিলিয়ে আওয়ামী লীগের জয়ের হার ৫৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে মোট ৪ হাজার ১০৪টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ ২ হাজার ৬৫২টি, অর্থাৎ প্রায় ৬৫ শতাংশ ইউপিতে জয় পেয়েছিল।
এবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি ভোটে না থাকায় আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে। যাঁদের বড় অংশ নৌকা না পেয়ে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। মূলত স্বতন্ত্র ও বিএনপির নেতারাও এবার আওয়ামী লীগের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এখন দেশে নির্বাচনব্যবস্থা বলে কিছু নেই। তাই বিএনপি ইউপি নির্বাচনে নেই। ক্ষমতাসীনদের মূল সমস্যা ধানের শীষ। এখন যেহেতু ধানের শীষ নেই, তাই আগের মতো দমন–পীড়ন, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, এজেন্ট থাকতে না দেওয়া, পুলিশি ঝামেলা—এসব তুলনামূলক কম। জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন—সব নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনদের প্রধান সমস্যা ধানের শীষ।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট অফিস, প্রতিনিধি ও নিজস্ব প্রতিবেদকেরা।)